ছোট থেকে মনিরুলের নৌকা তৈরী করাই একমাত্র পেশা

রনজিৎ বর্মন শ্যামনগর(সাতক্ষীরা)প্রতিনিধি ঃ ভাল মন্দ কিছুই বুঝতে শেখেননি। শুধু খেলাধূলা করেই সময় কেটে যেত। দিনে রাতে কখনও পিতাকে ভাল করে কাছেও পাননি। পরিবারের আয়ের একমাত্র ব্যক্তি হল পিতা। আয়ের জন্য প্রতিনিয়ত সুন্দরবনে মাছ ধরার কাজে যেতে হত। এ অবস্থায় পিতা সুন্দরবনে মাছ ধরতে যেয়ে রান্নার জ¦ালানী সংগ্রহ করতে যেয়ে সুন্দরবনের পাগড়াতলি খালে বাঘের আক্রমনে পিতা মারা যান। তখন বয়স মাত্র দশ বছর। পিতা মারা যাওয়ার পর মা দিশেহারা হয়ে পড়লেন। কিভাবে বোনদের লেখাপড়া শিখাবেন, সংসার খরচ চালাবেন এসব ভাবনায়। পৈত্রিক সুত্রে জমির পরিমান ছিল আড়াই শতক। যেখান থেকেও আয়ের কোন উৎস ছিলনা। এ পরিস্থিতিতে মা মাত্র দশ বছর বয়সে নিজ চাচা আফসার আলীর সাথে থেকে নৌকা তৈরীর কাজ শেখার জন্য যুক্ত করে দিলেন। সেই থেকে শুরু হল জীবন সংগ্রাম। এই সংগ্রামী ছেলেটাই হল মোঃ মনিরুল ইসলাম। সাতক্ষীরা জেলার আশাশুনি উপজেলার প্রতাপনগর কুড়িগাহনিয়া গ্রামের পিতা মৃত মোঃ মুনসুর গাজী ও মাতা রাবেয়া সুলতানার ছেলে। এখন তার বয়স চল্লিশ বছর। ছোট থেকে কাজ শিখতে যেয়ে লেখাপড়া শেখা ভাগ্যে জুটেনি।
বাড়ীতে চাচার সাথে বিনা মজুরীতে দুই বছর নৌকা তৈরীর কাজ শেখার পর মামাত ভাই সালাম মিস্ত্রীর সাথে আরও এক বছর বিনা পারিশ্রমিকে কাজ করেন। এরপর নতুন একজনের সাথে যুক্ত হন কাজ শেখার জন্য পারিশ্রমিক হিসাবে তিন বেলা খাওয়া পান। এ সময়ে তার মা অন্যের বাড়ীতে জনমজুরী খেটে সংসারের ব্যয় নির্বাহ করতেন। এভাবে মনিরুল ইসলাম কাজ করতে করতে যখন তার বয়স পনের হল সেবছর নৌকা তৈরীর মজুরী হিসাবে এক বছরে ৬ হাজার টাকা পান। সালটা ছিল ইংরেজি ১৯৯৫। জীবনের প্রথম পারিশ্রমিকের এক বছরের মজুরীর টাকা মায়ের হাতে তুলে দেন। এক বছর পর থেকে মাসিক ৬শত টাকা মজুরীর চুক্তিতে কাজ শুরু করলেন মনিরুল ইসলাম। তার কাজের মান ভাল হওয়ায় হেড মিস্ত্রী দুই মাস পর আরও মজুরী বাড়িয়ে দিলেন। এভাবে দিনে দিনে মজুরী বাড়তে থাকল এবং তিনিও পরিপূর্ণভাবে কাজটি শেখার পর নিজেই পৃথকভাবে নৌকা তৈরীর অর্ডার নেওয়া শুরু করলেন।
মনিরুল ইসলাম বলেন উপকূলের নদী সংলগ্ন এলাকা পিরোজপুর, ভান্ডারিয়া, চিনিচাম্পাই, মোংলা, রামপাল, বাগেরহাট, সাতক্ষীরার কৈখালী, মুন্সিগঞ্জ, ভেটখালী, নৈকাটি, আশাশুনি প্রতাপনগর,কালিগঞ্জ সহ অন্যান্য স্থানে এ পর্যন্ত ছোট বড় সব মিলিয়ে প্রায় ১০ হাজার নৌকা তৈরী করেছেন। বর্তমানে তিনি শ্যামনগর উপজেলার মুন্সিগঞ্জ বাসস্ট্যান্ডে ঐশি নৌকা কারখানায় চুক্তিভিত্তিক এক একটি নৌকা তৈরী করছেন। মজুরী হিসাবে তিনি জানান ১৬ হাত নৌকা তৈরী মজুরী ৬ হাজার টাকা, ১৮ থেকে ২২ হাত লম্বা নৌকা তৈরীর মজুরী ৭ হাজার টাকা। সাগরে মাছ ধরার নৌকা তৈরীর মজুরী প্রায় ১ লক্ষ টাকা পান। নৌকা তৈরীর সময়সীমা জানান ১৬ হাত নৌকা তৈরীতে সময় লাগে এক সপ্তাহ কাজ করেন দুই জন। ২০ হাত নৌকা তৈরীতে সময় লাগে ১০ দিন, ২২ হাত নৌকা তৈরীর সময় লাগে ১৪দিন। আর সাগরের বড় ধরনের নৌকা তৈরীর সময় লাগে এক মাস পনের দিন। নৌকা তৈরির জন্য বর্তমানে তিনি সহ আরও একজন স্থানীয় অল্প বয়সী ছেলেকে সাহায্যকারী হিসাবে রেখেছেন। কাজের পরিমান বেড়ে গেলে লোকবলও বাড়িয়ে থাকেন। নৌকা তৈরীর কাঠ হিসাবে ব্যবহার করা হয় রৈইনট্রি, মেহগনি, খৈকাঠ, শিশু কাঠ। বর্তমানে এক সেফটি রেইনট্রি কাঠের দাম জানান তিন শত পঞ্চাশ টাকা। একটি সাধারণ মাপের নৌকা তৈরীতে ৩৫ থেকে ৪০ সেফটি কাঠ প্রয়োজন হয়। বড় ছোট নৌকা হলে কাঠ কম বেশি হয়ে থাকে। তিনি বর্তমানে নৌকা তৈরীর মজুরী গ্রহণ করেন। নৌকার কাঠ ক্রয়, পেরেক, জলুই, রং বা অন্যান্য কিছু খরচ মালিক পক্ষ বহন করেন। কারখানার মালিক প্রতিটি নৌকা বিভিন্ন দামে অর্ডার নেন। তার কাজ দেখা শুনা করা ও নৌকার অর্ডার গ্রহণের জন্য মালিক পক্ষ থেকে একজন ম্যানেজার নিযুক্ত করা হয়েছে। তিনিও বেতনভুক্ত একজন কর্মচারী।
তিনি জানান তার তৈরী নৌকা সাধারণত সুন্দরবনের জেলে, বাওয়ালী, মৌয়ালীরা ব্যবহার করেন। মুন্সিগঞ্জ বাসস্ট্যান্ডে প্রায় ৪ বছর ধরে এই নৌকা তৈরীর কাজ করছেন। এখানে একটি রুম ভাড়া নিয়ে নিজেই রান্না করে খেয়ে কাজ করেন এবং সাথে থাকা সাহায্যকারীকেও মাসিক ৬ হাজার টাকা মজুরী প্রদান করেন এবং দুপুরে খেতে দেন। মাসে সব খরচ বাদে গড়ে ১৩ থেকে ১৫ হাজার টাকা আয় করেন। প্রতি মাসে গড়ে তিনটি নৌকা তৈরী করে থাকেন বলে জানান। নৌকা তৈরীর কাজ থেকে আয় করে সাতক্ষীরা জেলা সদরের ব্যাংদহ নামক স্থানে ৭ কাঠা জমি কিনে বসবাস করছেন। পৈত্রিক জমি আশাশুনির প্রতাপনগর ভাংগনকুল থাকায় বা নদী ভাংগনে চলে যাওয়ায় জেলা সদরে ছোট একটি বাড়ী করেছেন। যেখানে তার স্ত্রী, তিন মেয়ে ও মা বসবাস করছেন। এই আয়ের উপর তার পরিবারের সকল খরচ চলে। ভবিষ্যতে সড়কের পাশে আরও স্বল্প পরিসরে জমি কিনবেন বলে জানান। তিন কন্যা সন্তানের মধ্যে বড় কন্যা মনিরা এসএসসি পাশ, মেজ কন্যা মর্জিনা এবার এসএসসি দিবেন আর ছোট কন্যা মোবাশে^র সুলতানা পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রী।
মনিরুল ইসলাম বলেন বর্তমানে সুন্দরবনে জেলেদের উপর বনদস্যুর আক্রমণ থাকায় নৌকা তৈরীর অর্ডার কম হচ্ছে। জেলে বাওয়ালীরা যখন স্বাচ্ছন্দে নির্ভয়ে সুন্দরবনে যেতে পারেন তখন অর্ডারও ভাল পাওয়া যায়। এক্ষেত্রে তিনি সুন্দরবনের সম্পদ আহরণকারীদের নিরাপত্তা বৃদ্ধির জন্যও প্রশাসনের সুদৃষ্টি কামনা করেন।
নৌকা তৈরী তার পেশা বা নেশা হিসাবে জানান। এই কাজটি করতে তার খুব ভাল লাগে। এই কাজের উপর দিয়েই বসবাসের জায়গা কিনেছেন, বাড়ী তৈরী করেছেন, মেয়েদের লেখাপড়া শেখাচ্ছেন বলেই এই পেশাকে তিনি খুব সম্মান করেন। তবে তিনি মালিক পক্ষের নিকট থেকে কোন উৎসব উপলক্ষে উৎসব ভাতা পাননা বলে জানান। এটি পেলে আরও উপকৃত হতেন বলে জানান। মনিরুল ইসলাম বলেন কোনসময়ই তার পেশাকে ছোট করে দেখেননি। পিতা সুন্দরবনে বাঘের আক্রমণে মারা যাওয়ার কারণে তার মাও তাকে সুন্দরবনে মাছ ধরে আয় করার স্বপ্ন কোনদিন দেখাননি। এজন্য এই পেশাকে তিনি ছোট না ভেবে মনে প্রাণে ভালবেসে দিনেরপর দিন এগ্রিয়ে চলেছেন। তার মতে মানুষ পছন্দসই কর্মক্ষেত্র তৈরী করতে পারলে একদিন সফলকাম হবেন বলে মতামত প্রকাশ করেন।