কৃষি জমিতে পুকুর খননের হিড়িকে জমি কমেছে ১৪ হাজার ৯৪০ বিঘা

জুয়েল রানা, সিরাজগঞ্জ প্রতিনিধি:
সিরাজগঞ্জের তাড়াশে ভূমি ব্যবস্থাপনা নীতিমালা লঙ্ঘন করে তিন ফসলি উর্বর জমি নষ্ট করে দিন ও রাত মিলে অবৈধভাবে চলছে পুকুর খনন।
বিশেষ করে অপরিকল্পিতভাবে যেখানে সেখানে পুকুর খনন করায় বন্ধ হয়ে যাচ্ছে ব্রিজ ও কালভার্টের মুখ। রাস্তার ধারে চোখের সামনে শত শত বিঘা ফসলি ও আবাদি জমি নষ্ট করে পুকুর খননের কাজ চললেও স্থানীয় প্রশাসনকে তেমন কোনো ভূমিকা রাখতে দেখা যায়নি। ফলে পুকুর খননের কারণে প্রতিনিয়ত তাড়াশ উপজেলার প্রায় শত শত বিঘা ফসলি জমি নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। অনেক জায়গায় পুকুর খননের কারণে পানি আটকে জলবদ্ধতা দেখা দিয়েছে। এতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতির মুখে পড়ছেন ওই অঞ্চলের প্রান্তিক কৃষকরা। তারা সেখানে ফসল উৎপাদন করতে পারছেন না। ফলে সেখানকার জমিগুলো অনাবাদি হয়ে পড়ে রয়েছে। দিনের বেলায় প্রশাসনের ঝামেলা এড়াতে কৌশলে রাতের অন্ধকারে অতিরিক্ত ভেকু মেশিনের মাধ্যমে পুরো রাত জেগে পুকুর খননের কাজ করা হচ্ছে। স্থানীয়রা বলছেন, দ্রুত এই পুকুর খনন বন্ধ করা না গেলে একসময় এ অঞ্চলে আর কোনো ফসলি জমি থাকবে না। এক্ষেত্রে এ অঞ্চলের চরম খাদ্য ঘাটতির আশঙ্কা দেখা দিতে পারে।
সরেজমিনে ঘুরে দেখা যায়, তাড়াশ উপজেলার নওগাঁ ইউনিয়নের বিরৌহালি স্কুলের দক্ষিণে ২০ বিঘা আয়তনের পুকুর খনন চলছে। ভায়াট গ্রামে খালকুলা সড়কের মসজিদের পশ্চিম পাশে বড় বড় কয়েকটি পুকুর খনন করা হচ্ছে।
তিনটি ভেকু মেশিন দিয়ে খালকুলা-মহিষলুটি সড়কের পাশের রাস্তার দক্ষিণে প্রায় একই রকম আয়তনের পুকুর খনন করা হচ্ছে। পুকুরটির সঙ্গেই ৭২ বিঘা আয়তনের পুকুর খনন চলছে। মহিষলুটি-নওগাঁ সড়কের পশ্চিমে একই জায়গাতে একটি ৫২ বিঘা, দুইটি ২০ বিঘা ও একটি ১৭ বিঘা আয়তনের পুকুর খনন করা হচ্ছে ভেকু মেশিন দিয়ে। এ ছাড়া মহিষলুটি সড়কের পশ্চিম পাশে গোয়াল গ্রামে ১৭ বিঘার ফসলি জমিতে পুকুর খনন হচ্ছে। মাগুড়া বিনোদ ইউনিয়নের মাগুড়া-নাদোসৈয়দপুর সড়কের মধ্যে কাটা গাঙ সেতুর সঙ্গে পুকুর খনন হচ্ছে। দেবীপুর গ্রামে দেবীপুর মাদ্রাসার সঙ্গে বেশ বড় আয়তনের পুকুর খনন চলছে। তালম ইউনিয়নের তালম নগরপাড়ায় পুকুর খনন চলছে। তাড়াশ পৌর এলাকার কাউরাইল গ্রামে একাধিক পুকুর খনন করা হচ্ছে। এ ছাড়াও আরও অনেক জায়গায় চলছে পুকুর খননের কার্যক্রম।
এদিকে অবৈধ পুকুর খনন বন্ধে সুনির্দিষ্ট আইন থাকার পরও তাড়াশ উপজেলা প্রশাসনের নীরব ভূমিকা নিয়ে জনমনে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। দিন ও রাত মিলে অবাধে পুকুর খনন করা হলেও প্রতিকারে প্রশাসনের কোনো শক্ত পদক্ষেপ নেই বলে অভিযোগ করছেন স্থানীয় কৃষকরা।
নওগাঁ ইউনিয়নের মাটিয়া মালিপাড়া গ্রামের কৃষক আরবান আলী, কেতাব আলী ও বাঁশবাড়িয়া গ্রামের কৃষক আব্দুর রশিদ, রহমান আলী, মোজদার হোসেন বলেন, ‘হাটিকুমরুল-বনপাড়া মহাসড়কের উত্তরে বড় বিল, দক্ষিণে ছোট বিল।
মূলত বিলের বিস্তীর্ণ মাঠের জমিতে বছরে তিনবার ফসলের আবাদ হয়। বোরো ধান, রোপা আমন ও সরিষা। এ বছর বিলের মাঠে যে পরিমাণ অবৈধ পুকুর খনন করা হচ্ছে, অন্য জমিগুলো নিশ্চিত জলাবদ্ধতার কবলে পড়ে থাকবে। ভূমি আইন লঙ্ঘন করে ও প্রশাসনের অনুমতি ছাড়াই দুই ফসলি আবাদি জমিগুলো পুকুরে রূপান্তরিত করে ফেলছে। এ বিষয়ে দেখার ও বাধা দেওয়ার কেউ নেই।
এসব পুকুরের পাড় ঘেঁষে আমাদের যেটুকু জমি রয়ে যাচ্ছে, বৃষ্টি নামলে নিশ্চিত সেখানে জলাবদ্ধতা দেখা দেবে। কারণ পুকুরের পাড় দিয়ে পানি বের হয়ে যাওয়ার রাস্তা বন্ধ করে ফেলছে পুকুর খননকারীরা। আমরা তাদের কিছু বলতে গেলেই বিভিন্ন ভয়ভীতি ও হুমকি দেয়। স্থানীয় প্রশাসনও তেমন কার্যকরী ভূমিকা পালন করছে না।’
তাড়াশ উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, ‘গত কয়েক বছরে তাড়াশ উপজেলায় ছোট বড় মিলে প্রায় ১৫০০ বেশি পুকুর খনন করা হয়েছে। কয়েক বছরে আবাদি কৃষি জমি কমেছে ১৪ হাজার ৯৪০ বিঘা। প্রায় ৭ হাজার বিঘা জমি জলাবদ্ধতা দেখা দিয়েছে। একই সঙ্গে শস্যভাণ্ডার হিসেবে খ্যাত তাড়াশ উপজেলায় খাদ্য উৎপাদন ব্যাপক হারে কমতে শুরু করেছে। আর এভাবে পুকুর খনন কার্যক্রম চলতে থাকলে একসময় এ অঞ্চলের আবাদি জমি থাকবে না, সব জমি পুকুরে রূপান্তরিত হবে।’