সম্পাদকিয়

বিশ্ব দুগ্ধদিবসঃ “মানব সম্পদ উন্নয়ন এবং মেধাবী জাতি গঠনে দুধ ও দুগ্ধজাত পণ্যের ভূমিকা”

বিশ্ব দুগ্ধদিবসঃ “মানব সম্পদ উন্নয়ন এবং মেধাবী জাতি গঠনে দুধ ও দুগ্ধজাত পণ্যের ভূমিকা”

 

 

১ জুন, বিশ্ব দুগ্ধ দিবস। জাতিসংঘের অঙ্গসংগঠন খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (FAO) সর্বপ্রথম ২০০১ সালের ১ জুনকে বিশ্ব দুগ্ধ দিবস হিসেবে উদযাপনের ঘোষণা দেন। তার পর হতে বিশ্বের প্রায় ৪০টিরও বেশী দেশে এই দিবসটি উদযাপিত হয়ে আসছে। তবে ১ জুন কোন কারণে উদযাপন করতে না পারলে জুনের প্রথম সপ্তাহে (১—৭) যে কোন দিন দিবসটি উদযাপন করা যায়। দিবসটি উদযাপনের উদ্দেশ্য হলো বৈশ্বিক খাদ্য হিসেবে দুধের গুরুত্ব তুলে ধরা এবং জনগণের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি করে ডেয়রী শিল্পের বিকাশ ঘটানো। প্রতি বছরই এই দিনটির একটি প্রতিপাদ্য বিষয় থাকে। এই বছরের প্রতিপাদ্য বিষয় হলো, “লেটস সেলিব্রেট দি পাওয়ার অব ডেয়রি” অর্থাৎ আসুন দুধ ও দুগ্ধজাত পণ্যের ক্ষমতা উদযাপন করি। এটি একটি যুগোপযোগী স্লোগান। অবশ্যই দুধ ও দুগ্ধজাত পণ্য প্রচন্ড ক্ষমতার অধিকারী। আমরা জানি উন্নতদেশ গড়তে হলে দক্ষমানব সম্পদ দরকার। আর এই মানব সম্পদ উন্নয়নে দুধ ও দুগ্ধজাত দ্রব্যাদির ভুমিকা অপরিসীম।

দুধ প্রকৃতির শ্রেষ্ঠ খাবার। জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত জীবনের প্রতিটি স্তরেই রয়েছে দুধের প্রয়োজনীয়তা। খাদ্যের ছয়টি উপাদান (পানি, আমিষ, চর্বি, শর্করা, মিনারেল ও ভিটামিন) সুষমভাবে দুধে উপস্থিত থাকায় এটিকে শুধুমাত্র পানীয় না বলে আদর্শ খাদ্যও বলা হয়। স্বাভাবিক গাভীর দুধে প্রায় ৮৭.৫% পানি, ৩.৫% আমিষ, ৩.৫% দুগ্ধ চর্বি, ৪.৮৫% দুগ্ধ শর্করা, ০.৬৫% খনিজ পদার্থ এবং প্রচুর পরিমাণে পানিতে এবং চর্বিতে দ্রবণীয় ভিটামিন রয়েছে।

মানব সম্পদ উন্নয়নে এবং মেধাবী জাতি গঠনে দুধ ও দুগ্ধজাতপণ্য নিবিড়ভাবে জড়িত। দুধের আমিষ প্রকৃতির শ্রেষ্ঠ আমিষ, এতে জীবন ধারণের জন্য অত্যাবশ্যকীয় সব গুলো এসাইনো এসিড সুষম আকারে বিদ্যমান। পক্ষান্তরে উদ্ভিদ আমিষে অত্যাবশ্যকীয় এমাইনো এসিড লাইসিন, মিথিওনিন এবং ট্রিপটোফেন এর ঘাটতি থাকায় শরীরে প্রোটিন সিনথেসিস প্রক্রিয়ায় বিঘ্ন ঘটে এবং শরীরের বর্ধন এবং ক্ষয়পূরন যথাযথ ভাবে হয় না। প্রতিদিন এক গ্লাস দুধ (২০০—২৫০ মিলি) পান করলে অন্যান্য আমিষের এমাইনো এসিডের ঘাটতি পূরণ হয়ে যায়। দুধের আমিষের প্রায় ৮০% হল কেসিন এবং বাকী ২০% হোয়ে আমিষ নামে পরিচিত। পৃথিবীর আর কোন খাদ্যে কেসিনের উপস্থিতি নেই। এটাই দুধের শ্রেষ্ঠত্ব। শিশুদের বৃদ্ধির জন্য দুধের আমিষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে, তাছাড়া দুধে উপস্থিত দুগ্ধ শর্করা (যা ল্যাকটোজ নামে পরিচিত) শিশুদের মস্তিস্কের কোষ বর্ধনে সহায়তা করে। তাই যে সকল শিশু বেশী বেশী দুধ পান করার সুযোগ পান তারা বেশী মেধাবী হয়ে থাকে। মনে রাখতে হবে জন্মের পর ৬—৭ বৎসরের ভিতর মানুষের ব্রেইন এর প্রায় ৯০% বর্ধন হয়ে থাকে। সে জন্য জন্মের পর থেকে ৬—৭ বৎসর পর্যন্ত বাচ্চাদের প্রতিদিন দুধ খাওয়াতে পারলে তারা মেধাবী জাতিতে পরিণত হয়। এখানে উল্লেখ্য যে, ল্যাকটোজ শুধুমাত্র দুধেই পাওয়া যায়। প্রকৃতির অন্য কোন খাদ্যে ল্যাকটোজ নেই, যার ফলে মস্তিষ্কের বৃদ্ধির জন্য দুধের কোন বিকল্প নেই। তাছাড়া দুধের মাঝে প্রচুর পরিমাণে মিনারেল জাতীয় খাদ্য উপাদান যেমন, ক্যালশিয়াম, ফসফরাস, ম্যাগনেশিয়াম ইত্যাদির উপস্থিতি শরীরের হাড় ও দাঁতের বর্ধন ও গঠনে সহায়তা করে। যার ফলে বাচ্চাদের শারীরিক কাঠামো মজবুত হয়।

অনিদ্রা, উচ্চরক্তচাপ ও হৃদরোগ প্রতিরোধেও দুধ উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে থাকে। রাত্রে ঘুমাতে যাওয়ার পূর্বে এক গ্লাস ইষদউষ্ণ দুধ পান করলে প্রচুর ঘুম হয়ে থাকে। দুধে উপস্থিত এমাইনো এসিড ট্রিপটোফেন ভেঙ্গে, মেলানিন এবং সিরোটনিন নামক দুইটি কেমিক্যাল তৈরী হয় যা ঘুমাতে সাহায্য করে। যারা ঘুমের বড়ি খেয়ে অভ্যস্ত তারা ঘুমের বড়ি ছেড়ে দিয়ে এক গ্লাস দুধ পানের অভ্যাস করলে ঘুমও হবে এবং ঔষধের পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া থেকে বেঁচে যাবেন। দুধে অবস্থিত ক্যালশিয়াম, পটাশিয়াম এবং ম্যাগনেশিয়াম উচ্চরক্তচাপ নিয়ন্ত্রনে সাহায্য করে থাকে। আমাদের রক্তে অবস্থিত এনজিওটেনসিন কনভারটিন এনজাইম (ACE) রক্তের এনজিওটেনসিন—১ হরমোনকে যখন সক্রিয় করে এনজিওটেনসিন—২ হরমোন তৈরী করে তখন এই সক্রিয় এনজিওটেনসিন—২ হরমোন ভাসকুলার পেশীকে সংকুচিত করে এবং এতে রক্তের চাপ বেড়ে যায়। কিন্তু দুধের আমিষ এবং এসেনসিয়াল ফ্যাটি এসিড এই (ACE) এনজাইম অকেজো করে রাখতে পারে। যার ফলে ইনএকটিভ এনজিওটেনসিন—১ হরমোন একটিভ এনজিওটেনসিন—২ তে রূপান্তরিত হতে পারে না, তাই রক্তচাপ নিয়ন্ত্রনে থাকে। অনেকে মনে করে থাকেন দুগ্ধচর্বি হৃদরোগের কারণ, আসলে সেটা সম্পূর্ণ ঠিক নয়। সেচুরেটেড এবং ট্রান্স ফ্যাটকে হৃদরোগের জন্য দায়ী করা হয়। কিন্তু দুধের ফ্যাট এর প্রায় ৪০% আনসেচুরেটড ফ্যাট, যা HD বাড়াতে সাহায্য করে। অন্য দিকে দুধের সকল সেচুরেটেড ফ্যাট হৃদরোগের জন্য দায়ী নয়। লরিক, মাইরেস্টিক এবং পালমেটিক এসিডকে হৃদরোগের জন্য বেশী দায়ী করা হয়, এদের পরিমাণ এক গ্লাস দুধে খুবই কম। একজন সুস্থ মানুষ যদি এক গ্লাস দুধ খান তাতে যে পরিমাণ ফ্যাট থাকে তা বিপাকীয় প্রক্রিয়ায় এনার্জি তৈরীতে খরচ হয়ে যায় এবং হৃদরোগের আশংকা থাকে না। তবে যারা হৃদরোগে আক্রান্ত তারা দুধের চর্বি উঠায়ে চর্বিবিহীন দুধ খেলে কোন ক্ষতি হবে না। মনে রাখতে হবে খাদ্যে কিছু পরিমাণ ফ্যাট থাকতেই হবে অন্যত্থায় গোনাডোট্রফিক হরমোন তৈরী বাধা গ্রস্থ হবে।

বয়স্কদের অস্টিওপরোসিস এবং দাঁতের ক্যারিস নিয়ন্ত্রণে দুধের ক্যালসিয়াম ও ফসফরাস উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে থাকে। প্রতিদিন একগ্লাস দুধ খেলে এই সকল সমস্যা থেকে পরিত্রাণ পাওয়া যায়। ডায়াবেটিকে আক্রান্ত লোকজন অনায়াসেই দুধ খেতে পারেন, গবেষণায় দেখা গেছে দুধ খেলে ১৪% পর্যন্ত টাইপ—২ ডায়াবেটিসের ঝুঁকি কমে আসে। দুধের শর্করা (ল্যাকটোজ) মস্তিষ্কের কোষের বর্ধন এবং যত্ন করে বিধায় দুধ পান করা জাতি বেশী মেধাবী হয়। গবেষণায় দেখা গিয়েছে সুইডেন ও সুইজারল্যাণ্ডের জনগণ প্রতিদিন ৮২০ থেকে প্রায় ৯৬০ মিলি দুধ পান করে। যার ফলে তাদের মধ্যে নভেল পুরষ্কার প্রাপ্ত বিজ্ঞানীর সংখ্যা অনেক বেশী, প্রতি ১০ মিলিয়নে প্রায় ৩২—৩৩ জন। অন্যদিকে যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রের জনগণ প্রতিদিন ৬৬০—৬৮৫ মিলি দুধ পান করে এবং তাদের প্রতি ১০ মিলিয়নের মধ্যে নভেল পুরষ্কার প্রাপ্তির সংখ্যা প্রায় ১০—১২ জন। এতে বুঝা যায় মেধাবী জাতি গঠণের ক্ষেত্রে দুধের ভূমিকা উল্লেখযোগ্য।

দুধের এত গুণাগুন থাকার পরও কোন কোন মানুষ দুধ হজম করতে পারে না। দুধ খেলে তাদের পেটের নানাবিদ সমস্যা দেখা দেয়। এটিকে বলা হয় ল্যাকটোজ ইনটলারেন্স সিনড্রোম। এর মূল কারণ হল এ ধরণের মানুষের শরীরে ল্যাকটোজ হজম করার জন্য ল্যাকটেজ এনজাইমের ঘাটতি রয়েছে। কিছুদিন দুধ পান করলে ধীরে ধীরে শরীরে ল্যাকটেজ এনজাইমটি তৈরী হতে থাকে এবং এক সময় তিনি দুধ হজমে অভ্যস্থ হয়ে পড়েন। যদি এই এনজাইম শরীরে কোন সময়ই তৈরী না হয় তা হলেও হতাশ হবার কিছু নেই। তারা দুধ থেকে তৈরী দই কিংবা অন্যান্য ফারমেন্টেড ডেয়রী ফুড অনায়াসে খেতে পারেন। কারণ ফারমেন্টেড ডেয়রী ফুডে ল্যাকটোজের পরিমাণ কম থাকে। তাছাড়া দই তৈরীতে প্রোবায়োটিক ব্যাকটেরিয়া ব্যবহৃত হয়, যা শরীরের অনেক উপকার করে থাকে।

বাংলাদেশের ডেয়রী শিল্প অনেক এগিয়েছে। আমাদের ন্যুনতম প্রয়োজন প্রতিদিন ২৫০ মি.লি. তরল দুধ। বর্তমানে আমাদের প্রাপ্যতা প্রায় ৩৩৫ মি.লি। আমরা আমাদের চাহিদা পূরণের প্রায় দারপ্রান্তে। কৃষির বিভিন্ন সেক্টরের সাথে তাল মিলিয়ে আজ ডেয়রী শিল্পেও বিপ্লব সাধিত হয়েছে। মেধাবী জাতি গঠনে দুধের কোন বিকল্প নাই। তাই মানব সম্পদ উন্নয়নের মাধ্যমে মেধাবী এবং স্বয়ংসম্পূর্ণ বাংলাদেশ গড়ে তুলতে হলে দুগ্ধ শিল্পকে সামনের দিকে এগিয়ে নিতে হবে।

 

প্রাক্তন বিভাগীয় প্রধান, ডেয়রী বিজ্ঞান বিভাগ

ও ডীন, ফ্যাকাল্টি অব এনিম্যাল হাজভেন্ড্রি,

বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ।

এবং ট্রেজারার,এশিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ

You may also like

সম্পাদকিয়

বদলে যাচ্ছে কৃষি, ঝুঁকিতে স্বাস্থ্য

There are many variations of passages of Lorem Ipsum available but the majority have suffered alteration in that some injected
Uncategorized সম্পাদকিয়

সম্পাদকের কথা

There are many variations of passages of Lorem Ipsum available but the majority have suffered alteration in that some injected