শিক্ষাঙ্গন

ইবির নববর্ষ যেন ঐতিহ্যের জীবন্ত চিত্র

মিজানুর রহমান, ইবি প্রতিনিধি:

কুষ্টিয়ার ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় যেন এক টুকরো রঙিন বাংলা। বাংলা নববর্ষ ১৪৩২ বঙ্গাব্দকে বরণ করে নিতে বিশ্ববিদ্যালয় জুড়ে ছিল উৎসবের আমেজ। কয়েক দিন ধরে চলে আসা প্রস্তুতি শেষ হয় বুধবার (১৬ এপ্রিল) তেসরা বৈশাখের আনন্দ শোভাযাত্রা ও দিনভর নানা আয়োজনের মধ্য দিয়ে। নতুন সূর্যের আলোয় জেগে ওঠা ইবি ক্যাম্পাস এদিন পরিণত হয় বাঙালির প্রাণের মেলায়।

 

বাঙালি জাতিসত্তার সুন্দরতম প্রকাশ এই বাংলা বর্ষবরণ। এটি শুধু একটি নতুন বছরের শুরু নয়, বরং বাঙালির নিজস্ব সংস্কৃতি, ঐতিহ্য আর গর্বিত ইতিহাসের প্রতিধ্বনি। ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের নববর্ষ উদযাপন যেন সেই প্রতিধ্বনিকে আরও জোরালো করে তোলে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, শিক্ষার্থী, কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা—সকলেই যেন আজ শিকড়ের টানে একাত্ম হয়েছিলেন। ধর্ম-বর্ণের ভেদাভেদ ভুলে সবাই মেতেছিলেন বাঙালির চিরায়ত উৎসবে।

 

এই আনন্দ শুধু আনন্দ নয়, এটি জাতির এক অনুপ্রেরণা। বর্ষবরণের এই দিনে বাঙালি তার আপন ঐতিহ্য, সাংস্কৃতিক স্বকীয়তা ও গৌরবময় জাতিসত্তার পরিচয়ে উদ্ভাসিত হয়। এই চেতনা যুগে যুগে বাঙালিকে ঐক্যবদ্ধ করেছে, মহান মুক্তিযুদ্ধে নিজস্ব অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে সাহস জুগিয়েছে, প্রেরণা জুগিয়েছে চব্বিশের জুলাইয়ের বিপ্লবে। আজ সেই একই চেতনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে এক নতুন মাত্রা পায়, যখন সকলে মিলিত কণ্ঠে গেয়ে ওঠে বাঙালির জয়গান।

পোশাক-পরিচ্ছদ থেকে শুরু করে আনন্দ শোভাযাত্রা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান—সবকিছুতেই ছিল বাঙালিয়ানার স্পষ্ট ছাপ। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি বিভাগ, অনুষদ, হল এবং বিভিন্ন সামাজিক ও রাজনৈতিক সংগঠন স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশ নেয় এই বর্ণাঢ্য আয়োজনে। প্রশাসনিক ব্যক্তিবর্গের উপস্থিতিও এই উৎসবকে আরও মহিমান্বিত করে তোলে। বর্ষবরণের শোভাযাত্রা ছিল ঐতিহ্যের এক জীবন্ত চিত্র। শোভাযাত্রার প্রধান আকর্ষণ ছিল গরুর গাড়ি ও পালকি। আধুনিকতার ভিড়ে হারিয়ে যাওয়া এই গ্রামীণ ঐতিহ্যবাহী বাহন দুটি যেন একমুহূর্তের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাঙ্গণকে বাংলার কোনো গ্রামে পরিণত করেছিল। গরুর গাড়িতে বরযাত্রীর বেশে সজ্জিত শিক্ষার্থীদের হাস্যোজ্জ্বল মুখ এবং পালকিতে নববধূর সাজে সজ্জিতা ছাত্রীদের স্নিগ্ধ রূপ—শোভাযাত্রায় এক ভিন্ন আকর্ষণ সৃষ্টি করে।

 

বাংলার মেয়েদের ঐতিহ্যবাহী নৃত্য পরিবেশনা ছিল মনোমুগ্ধকর। তাদের রঙিন পোশাক আর পায়ের ঘুঙুরের তালে তালে যেন প্রকৃতিও বৈশাখের আগমন বার্তা ঘোষণা করছিল। নৃত্যের প্রতিটি মুহূর্ত যেন বাঙালির সংস্কৃতি আর ঐতিহ্যের প্রতিচ্ছবি।

শোভাযাত্রায় গ্রামীণ বাংলার নানা অনুষঙ্গ তুলে ধরা হয়। ফসলের ক্ষেতের নীরব প্রহরী কাকতাড়ুয়া দর্শকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। নীল আকাশে রং-বেরঙের ঘুড়ির ওড়াওড়ি যেন শৈশবের সেই আনন্দময় দিনগুলোর স্মৃতি ফিরিয়ে আনে। শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন প্রাণীর মুখচ্ছবি ধারণ করে প্রকৃতির প্রতি তাদের গভীর ভালোবাসার প্রকাশ ঘটায়। এছাড়াও, বাংলার জমিদারী প্রথার একটি চিত্র তুলে ধরা হয়, যা সেই সময়ের সামাজিক প্রেক্ষাপট সম্পর্কে ধারণা দেয়।

কৃষিপ্রধান বাংলাদেশের মানুষের জীবন ও জীবিকার প্রতিচ্ছবিও শোভাযাত্রায় দেখা যায়। কৃষকদের ব্যবহৃত লাঙ্গল, জোয়াল, কোদাল, কাস্তে, ঢেঁকি, মাছ ধরার জাল, ঝুড়ি সহ বিভিন্ন কৃষি সরঞ্জাম প্রদর্শিত হয়। এটি নতুন প্রজন্মের কাছে কৃষি ঐতিহ্যের গুরুত্ব তুলে ধরে।

বাংলার লোকজ সংস্কৃতি ও বিভিন্ন পেশাজীবীদের জীবনযাত্রা এই শোভাযাত্রায় জীবন্ত হয়ে ওঠে। ঘটক, কাজী, জেলে, তাঁতি, কৃষক, দিনমজুর এবং বর-কনের চরিত্রে শিক্ষার্থীদের অভিনয় শোভাযাত্রাকে আরও প্রাণবন্ত করে তোলে। কৃষকদের আঞ্চলিক গানের তালে তালে কৃষিকাজ করার দৃশ্য দর্শকদের বিশেষভাবে আকৃষ্ট করে, যা গ্রামীণ জীবনের সরলতা ও কর্মমুখরতাকে ফুটিয়ে তোলে। বাংলা সাহিত্যের দুই উজ্জ্বল নক্ষত্র রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুল ইসলামের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করা হয় তাদের ছদ্মবেশ ধারণের মাধ্যমে। এছাড়াও, দেশের জন্য আত্মত্যাগকারী দেশপ্রেমিকদের স্মরণ করা হয়, যা নতুন প্রজন্মের মধ্যে দেশাত্মবোধের চেতনা সঞ্চার করে।

এই আনন্দ শোভাযাত্রা শুধু দেশীয় ঐতিহ্য আর সংস্কৃতির মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেনি, বরং আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটের প্রতিও দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। ফিলিস্তিনের জনগণের প্রতি সংহতি জানিয়ে শোভাযাত্রায় ফিলিস্তিনের পতাকা বহন করা হয়। এটি বিশ্বজুড়ে নিপীড়িত মানুষের প্রতি ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সমর্থন ও সহানুভূতির এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।

 

অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের এক সুন্দর চিত্রও এই বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে ফুটে ওঠে। বিভিন্ন ধর্ম ও বর্ণের মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ প্রমাণ করে যে, বৈশাখ বাঙালির মিলনক্ষেত্র, যেখানে কোনো ভেদাভেদ নেই। এই ঐক্য ও সম্প্রীতির বার্তাই বাংলাদেশের বহুত্ববাদী সংস্কৃতির মূল ভিত্তি।

সাম্প্রতিক সময়ের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ও আন্দোলনও এই শোভাযাত্রায় অভিনয়ের মাধ্যমে তুলে ধরা হয়। ২৪শে জুলাইয়ের আন্দোলন, স্বৈরাচারের প্রতিচ্ছবি ও ফ্যাসিবাদের মুখাকৃতি প্রদর্শন করা হয়। চব্বিশের জুলাই বিপ্লবের শহীদ আবু সাঈদ ও মুগ্ধের অবদানকে স্মরণ করা হয় এবং তাদের আত্মত্যাগের চিত্র অভিনয়ের মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলা হয়। সেই আন্দোলনে সহায়তাকারী সাহসী রিকশাচালকের ভূমিকাকেও অভিনয়ের মাধ্যমে তুলে ধরা হয়, যা সাধারণ মানুষের সাহস ও সংগ্রামী চেতনাকে সম্মান জানায়।

দিনের সমাপ্তি ঘটে ঐতিহ্যবাহী পান্তা ইলিশ ভোজনের মাধ্যমে। এরপর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে গান, নাচ ও আবৃত্তির মাধ্যমে বাঙালি সংস্কৃতির বিভিন্ন দিক তুলে ধরেন। এই অনুষ্ঠান যেন বাঙালির প্রাণের কথা বলে যায়।

 

বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. নকীব মোহাম্মদ নসরুল্লাহ জানিয়েছেন যে, ইবিতে শিক্ষক থাকা অবস্থায় তিনি কখনো এত বড় অনুষ্ঠান দেখেননি। বাংলা বিভাগসহ অন্যান্য বিভাগের সহযোগিতায় আয়োজিত শোভাযাত্রা তাকে অভিভূত করেছে। তাঁর মতে, এটি একটি সার্বজনীন অনুষ্ঠানে রূপ নিয়েছে। তিনি আরো বলেছেন যে, মুক্ত মন নিয়ে অনুষ্ঠিত এই আয়োজন জুলাই পরবর্তী বাংলাদেশের সফলতার প্রতিফলন। বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনসহ যেসব শহিদদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে এই অনুষ্ঠান সম্ভব হয়েছে, তাদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানিয়ে তিনি অনুষ্ঠানটি উৎসর্গ করেছেন।

 

বৈশাখ শুধু বাংলা বছরের প্রথম মাস নয়-এটি বাঙালি জাতির আবেগ, ইতিহাস ও ঐতিহ্য। এটি আমাদের শেকড়ের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়। গ্রামীণ বাংলায় বৈশাখ মানে নতুন ধানের আগমন, হালখাতা, বৈশাখী মেলা আর জারি-সারি গানের মুখরিত উৎসব। পিঠাপুলি ও মিষ্টিান্নের সমারোহে বৈশাখ যেন এক ভিন্ন মাত্রা পায়। হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের খেজুর ভাঙ্গার দৃশ্যও এক নতুন আমেজ সৃষ্টি করে। শহর কিংবা গ্রাম, পুরনো কিংবা আধুনিক—বৈশাখের আসল সৌন্দর্য তার মিলনে, তার সার্বজনীনতায়। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে মানুষ যেভাবে একসঙ্গে নববর্ষকে বরণ করে নেয়, সেটাই বৈশাখের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য। বৈশাখ আমাদের শেখায় পুরোনো জীর্ণতাকে ঝেড়ে ফেলে নতুন আশায় বুক বাঁধতে। ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের এই বর্ষবরণ উৎসব সেই অসাম্প্রদায়িক চেতনা ও ঐতিহ্যের প্রতি ভালোবাসারই এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। এই ধরনের আয়োজন নতুন প্রজন্মকে তাদের শিকড়ের সাথে যুক্ত করে এবং একটি সংস্কৃতিবান জাতি গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।

You may also like

Uncategorized শিক্ষাঙ্গন

নাজিরপুরে শিক্ষক কর্মচারী ঐক্যজোটের ত্রি-বার্ষিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত

পিরোজপুর প্রতিনিধি :বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটি অন্যতম সদস্য, বাংলাদেশ শিক্ষক কর্মচারী ঐক্যজোটের বরিশাল বিভাগীয় সমন্বয়ক ও কেন্দ্রীয় কমিটির প্রেসিডিয়াম সদস্য অধ্যক্ষ
Uncategorized শিক্ষাঙ্গন সারাদেশ

পিরোজপুর ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের মতবিনিময়

পিরোজপুর প্রতিনিধি: ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যায়ের উপাচার্যের পিরোজপুরে আগমন উপলক্ষে সংবর্ধনা, আলোচনা ও মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে।শনিবার (৩০ নভেম্বর) সকালে পিরোজপুর