ভরা মৌসুমেও চাঁদপুরে ইলিশের দাম আকাশছোঁয়া, সংকটে জেলেরা।

মো:রাজন পাটওয়ারী, স্টাফ রিপোর্টার চাঁদপুর:
ইলিশের জন্য বিখ্যাত চাঁদপুরে এখন ইলিশ কেনা যেন সাধারণ মানুষের সাধ্যের বাইরে। ভরা মৌসুমেও পাইকারি ও খুচরা বাজারে ইলিশের দাম বেশ চড়া। চাঁদপুর বড়স্টেশন মাছ বাজারে সবচেয়ে বড় আকারের ইলিশ বিক্রি হয়েছে কেজি প্রতি ২৭০০ টাকায়। এক কেজি ওজনের নিচের মাছের দামও ১৮০০ থেকে ২০০০ টাকা পর্যন্ত উঠেছে।
চাঁদপুর মৎস্য বণিক সমিতির তথ্যানুযায়ী, গতকাল শুক্রবার (১৫ আগস্ট) বাজারে প্রায় ৩০০ মণ ইলিশের সরবরাহ ছিল, যার মধ্যে মাত্র ১০০ মণ এসেছে পদ্মা-মেঘনা থেকে, বাকি সব উপকূলীয় অঞ্চল থেকে। স্বস্তির বিষয় হলো, গত সপ্তাহের তুলনায় কেজি প্রতি ২০০-২৫০ টাকা পর্যন্ত দাম কিছুটা কমেছে।
বর্ষার দিনে ইলিশের গন্ধে একসম noয় বাঙালির ঘরে উৎসবমুখর পরিবেশ থাকত। কিন্তু এখন সেই চিত্র অনেকটাই ফিকে।
সাগর কিংবা নদীতে ইলিশ থাকলেও, আগের মতো আর ধরা পড়ছে না। বিশেষ করে চাঁদপুরের পদ্মা-মেঘনায় ইলিশের উপস্থিতি অনেকটাই কম। স্থানীয় জেলেরা বলছেন, দক্ষিণের উপকূলীয় অঞ্চলে হাজারো জাল, বিশেষ করে নিষিদ্ধ কারেন্ট, মশারি ও ফাঁদ জালের কারণে ইলিশ ঝাঁকবেঁধে আর ওপরে উঠে আসতে পারে না। ফলে পদ্মা-মেঘনায় আগের মতো ইলিশ আসে না।
হরিণা ঘাটের প্রবীণ জেলে রশীদ ছৈয়াল বলেন, ‘আগে বর্ষায় নদীতে জাল ফেললেই ইলিশ পাওয়া যেত। এখন নদী ফাঁকা।’ একই অভিযোগ তুলেছেন আলমগীর শেখ নামের আরেক তরুণ জেলে, যিনি ছোট নৌকায় মাঝেমধ্যে ইলিশ পেলেও তা দিয়ে সংসার চালানো কঠিন। চাঁদপুর, শরীয়তপুর, লক্ষ্মীপুরসহ আশেপাশের অঞ্চলে লাখো জেলে পরিবার ইলিশ মাছ ধরেই জীবন-জীবিকা নির্বাহ করে। কিন্তু ইলিশের সংকটে এই পরিবারগুলো বর্তমানে চরম অর্থকষ্টে ভুগছে।
চাঁদপুরের বড়স্টেশন মাছ বাজারের ব্যবসায়ী সুমন খান জানান, একসময় এই বাজারে প্রতিদিন আড়াই থেকে তিন হাজার মণ ইলিশ বিক্রি হতো। এখন সেই পরিমাণ নেমে এসেছে ২-৩ শত মণের মধ্যে। বিশেষ করে পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পর দক্ষিণের নদী অঞ্চলের মাছ সরবরাহ চাঁদপুরে কমে গেছে। তবে বড় আকারের রাজা ইলিশ কিছুদিন ধরে বাজারে দেখা যাচ্ছে, যেগুলোর ওজন প্রায় ৩ কেজি, দাম ২৭০০ থেকে ৪০০০ টাকা পর্যন্ত হাঁকানো হচ্ছে। তবে তা সাধারণ ক্রেতাদের ধরাছোঁয়ার বাইরে।
চাঁদপুর জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মোহসীন উদ্দিন জানান, বড়স্টেশন সংলগ্ন তিন নদী ঘিরে একটি আধুনিক মৎস্য অবতরণ কেন্দ্র নির্মাণের পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। এখানে ক্রেতাদের সুবিধার্থে পর্যাপ্ত সরবরাহ ও পরিকাঠামো নিশ্চিত করা হবে, বিশেষভাবে ইলিশের জন্য। ইলিশ গবেষক ড. মোহাম্মদ আনিছুর রহমান বলেন, ‘ইলিশ হলো পরিভ্রমণশীল মাছ। কোথাও বাধা পেলেই ফিরে যায়। বর্তমানে সাগর-মোহনায় অসংখ্য চর, ডুবোচর গড়ে ওঠায় এবং জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ইলিশ নদীতে উঠে আসতে পারছে না। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে মাইক্রোপ্লাস্টিক দূষণ, যা জলজ প্রাণীর জন্য মারাত্মক হুমকি।’ তিনি আরও বলেন, ‘নিষিদ্ধ জাল ব্যবহার নিয়ন্ত্রণে কঠোর আইন প্রয়োগ এবং নদী দূষণ কমানোর কার্যকর উদ্যোগ ছাড়া সংকট দূর হবে না।’
মৎস্য বিভাগ জানায়, মার্চ-এপ্রিলে জাটকা সংরক্ষণ কর্মসূচি এবং অক্টোবরে ইলিশের ডিম ছাড়ার সময় ২৫ দিনের জন্য মাছ ধরা নিষিদ্ধ রাখা হয়। এতে কিছুটা সুফল মিলেছে। বর্তমানে দেশের ইলিশ উৎপাদন প্রায় পৌনে ৬ লাখ মেট্রিক টনে পৌঁছেছে বলে দাবি তাদের।