সিরাজগঞ্জের চলনবিলসহ ৯টি উপজেলায় চলতি মৌসুমে রেকর্ড পরিমাণ সরিষার চাষ হয়েছে। কৃষি সম্প্রসারণ কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, ৮৬ হাজার ৪৬০ হেক্টর জমিতে সরিষা চাষ করা হয়েছে, যা গত বছরের চেয়ে ১ হাজার ২৯০ হেক্টর বেশি। আবহাওয়া অনুকূল থাকায় সরিষার ফলন ভালো হয়েছে। এদিকে সরিষার মাঠ থেকে ৩৮২ টনের বেশি মধু আহরণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এর আনুমানিক মূল্য ১১ কোটি টাকা।
সম্প্রতি সরিষা খেতের পাশে মৌচাক ও মৌমাছি দিয়ে মধু আহরণে ব্যস্ত সময় পার করছেন মৌয়ালরা। এবারে সরিষার আবাদ ভালো হওয়ায় মধু আহরণও ভালো হচ্ছে। মৌয়ালরা ফসলের জমির পাশে মৌবাক্স স্থাপন করে মধু সংগ্রহ করছেন।
তাড়াশ উপজেলার চলনবিল, মহিষলুটি, মান্নাননগর, নাদোসৈয়দপুর, হামকুরিয়া, ঘরগ্রাম ও দোবিলাসহ বিভিন্ন এলাকায় সরিষা খেতের মাঝে উঁচু জায়গায় মৌবাক্স স্থাপন করে মৌয়ালরা মধু সংগ্রহ করছেন। মধু সংগ্রহের জন্য কাঠের বিশেষ বাক্স তৈরি করা হয়, যার ভিতরে মোম দিয়ে তৈরি কয়েকটি মৌচাক থাকে। প্রতিটি বাক্সে একটি রানি মৌমাছি রাখা হয়, যার কারণে হাজার হাজার মৌমাছি সেখানে এসে মধু সংগ্রহ করে।
মৌয়ালরা কয়েকদিন পর পর বিশেষ কৌশলে ধোঁয়া দিয়ে মৌচাক থেকে মৌমাছি সরিয়ে মেশিনের মাধ্যমে মধু বের করেন। পরে এই মধু বিভিন্ন পাত্রে ভরে স্থানীয়ভাবে পাইকারি ও খুচরা বিক্রি করা হয়। এভাবে, চাষিরা আর্থিকভাবে লাভবান হচ্ছেন এবং নতুন কর্মসংস্থানও তৈরি হচ্ছে। সরিষার মধু খাঁটি ও সুস্বাদু হওয়ায় এটি দেশের বিভিন্ন জায়গায় এবং বিদেশেও রপ্তানি হয়।
সাতক্ষীরা থেকে চলনবিলে আসা জুমজুম মৌ খামারের মালিক বাপ্পি রহমান বলেন, ‘গত কয়েক বছর ধরে এখানে মধু সংগ্রহ করছি। এ বছর চলনবিলের বিস্তীর্ণ সরিষা খেতের পাশে ১০০টির বেশি মৌবাক্স বসিয়েছি। গত এক সপ্তাহে মধু বেশ ভালো পাওয়া যাচ্ছে। ঠাণ্ডা কমলে মধু উৎপাদনের পরিমাণ আরও বাড়বে।’ তিনি আরও জানান, মধু ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের পাইকাররা কিনে নিয়ে যান। প্রতি কেজি মধু ৩০০ থেকে ৪০০ টাকায় বিক্রি করছেন।
মৌয়াল আব্দুস সামাদ জানান, এ বছর ১৮০টি মৌবাক্স স্থাপন করেছেন তিনি। ইতোমধ্যে এসব বাক্স থেকে ৫ মণ মধু সংগ্রহ করেছেন। যতদিন সরিষা ফুল থাকবে, ততদিন মধু সংগ্রহ করা হবে।
তাওহীদ মৌ খামারের মালিক সজীব হোসেন জানান, এ বছর সরিষার আবাদ ভালো হয়েছে। আবহাওয়া অনুকূল থাকায় মধু উৎপাদনও বেশি হতে পারে। তবে মধুর সঠিক বাজারব্যবস্থা না থাকার কারণে সিন্ডিকেটের মাধ্যমে মধুর সঠিক দাম পাওয়া যাচ্ছে না। এজন্য তিনি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে সঠিক ব্যবস্থা গ্রহণের আহ্বান জানিয়েছেন।
আল্লাহ দান মৌ খামারের মালিক গোলাম মোস্তফা জানান, ‘এ বছর সরিষা খেতে আগের চেয়ে বেশি মৌবাক্স বসানো হয়েছে। এর ফলে প্রতি সপ্তাহে ৫ থেকে ৮ মণ মধু উৎপাদন হচ্ছে। সরিষা খেতে মৌবাক্স বসানোর কারণে সরিষার ফলনও বাড়ছে। খাঁটি মধু কিনতে অনেকেই আসছেন। আশা করছি এবারে ভালো লাভ হবে।’
মধু ব্যবসায়ী রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে পাইকাররা মধু সংগ্রহ করতে আসেন। খেত থেকে সংগ্রহ করা উন্নতমানের মধু পাইকারি ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়। তবে মধু সংরক্ষণ, প্রক্রিয়াজাতকরণ ও বাজারজাতকরণের সঠিক ব্যবস্থা না থাকায় কাঙ্ক্ষিত দাম পাওয়া যাচ্ছে না। এজন্য চলনবিল অঞ্চলে একটি মধু প্রক্রিয়াজাতকেন্দ্র স্থাপন করা উচিত।’
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক আ. জা. মু. আহসান শহীদ সরকার বলেন, ‘এ বছর সিরাজগঞ্জে রেকর্ড পরিমাণ সরিষার আবাদ হয়েছে। এবার ৩৮২ টন মধু আহরণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। তবে সরিষা আবাদ ভালো হওয়ায় মধু উৎপাদন আরও বাড়তে পারে। পাইকারি দরে প্রতি কেজি মধু ৩০০ টাকা ধরলে, এর আনুমানিক মূল্য দাঁড়ায় ১১ কোটি টাকার বেশি। এই অঞ্চলে সরিষা চাষির সংখ্যা বেড়েছে। একই সঙ্গে মধু উৎপাদনও ভালো হচ্ছে। এতে বেকার যুবকদের জন্য নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে।’