শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসের আলোচনা সভায় চবি উপাচার্য: “নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণে জাতিকে ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে”

নয়ন চৌধুরী : জুলাই-আগস্ট গণআন্দোলনের ফলে অর্জিত নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণে জাতিকে ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যোগে যথাযোগ্য মর্যাদা ও ভাবগম্ভীর পরিবেশে ১৪ ডিসেম্বর ২০২৪ শহিদ বুদ্ধিজীবী দিবস পালন অনুষ্ঠানে চবি আয়োজিত আলোচনা সভায় দেশবাসীকে এ আহবান জানান মাননীয় উপাচার্য প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইয়াহ্ইয়া আখতার।
আজ শহিদ বুদ্ধিজীবী দিবস উদযাপন উপলক্ষ্যে সকাল ১০:০০ টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শহিদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের মাননীয় উপাচার্য প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইয়াহ্ইয়া আখতার, মাননীয় উপ-উপাচার্য (একাডেমিক) প্রফেসর ড. মোহাম্মদ শামীম উদ্দিন খান, মাননীয় উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) প্রফেসর ড. মোঃ কামাল উদ্দিন, রেজিস্ট্রার (ভারপ্রাপ্ত) প্রফেসর ড. মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম,
বিভিন্ন অনুষদের ডিনবৃন্দ প্রশাসনের সংশ্লিষ্টদের সাথে নিয়ে শহিদ বুদ্ধিজীবীদের স্মরণে বুদ্ধিজীবী চত্বরে দেশ-জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান শহিদ বুদ্ধিজীবীদের প্রতি পুষ্পার্ঘ অর্পণ করে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। পুস্পার্ঘ অর্পণ শেষে মাননীয় উপাচার্য ও উপ—উপাচার্যদ্বয়ের নেতৃত্বে চবি শহিদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধ চত্বর থেকে শোক র্যালি (মৌন মিছিল) শহিদ মিনার হয়ে প্রশাসন ভবনে এসে শেষ হয়।
এরপর চবি উপাচার্য দপ্তরের সম্মেলন কক্ষে বেলা ১১:০০ টায় “গণতান্ত্রিক বাংলাদেশে শহিদ বুদ্ধিজীবী দিবসের তাৎপর্য” শীর্যক আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। আলোচনা সভায় প্রধান অতিথি ছিলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের মাননীয় উপাচার্য প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইয়াহ্ইয়া আখতার। বিশেষ অতিথি ছিলেন চবি মাননীয় উপ-উপাচার্য (একাডেমিক) প্রফেসর ড. মোহাম্মদ শামীম উদ্দিন খান ও মাননীয় উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) প্রফেসর ড. মোঃ কামাল উদ্দিন।
আলোচনা সভায় চবি উপাচার্য বলেন, ‘বুদ্ধিজীবীরা বাঙালি জাতির সূর্য সন্তান। এ জাতির স্বাধীনতা সংগ্রামে তাদের অবদান চিরস্মরণীয়। তিনি বলেন, ১৯৭১ সালে ঐক্যের মাধ্যমে ৯ মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর অর্জিত হয় স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ। যত অত্যাধুনিক অস্ত্র থাকুক না কেন, ঐক্যের সামনে কিছুই টিকতে পারে না। একটা দেশের জন্য ঐক্য সবচেয়ে বড় শক্তি। মাননীয় উপাচার্য বলেন, রাজনৈতিক অধিকারের জন্য আমরা স্বাধীনতা অর্জন করেছিলাম। বিগত সাড়ে পনেরো বছর একটা জাতিকে দমিয়ে রাখা হয়েছিল। ২৪ এর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র ও গণআন্দোলনে দেশের আপাময় জনসাধারণ ৫ আগস্ট ২০২৪ স্বৈরশাসকের পতন করে অর্জন করে নতুন বাংলাদেশ। এ স্বাধীনতা আমাদের ধরে রাখতে হবে। তিনি আরও বলেন, আমরা পোষা বুদ্ধিজীবী চাই না। আমরা চাই চিন্তাশীল, সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠাকারী বুদ্ধিজীবী। তিনি নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণে শিক্ষার্থীসহ জাতিকে ঐক্যবদ্ধভাবে এগিয়ে আসার আহবান জানান।
চবি উপ-উপাচার্য (একাডেমিক) প্রফেসর ড. মোহাম্মদ শামীম উদ্দিন খান বলেন, বুদ্ধিজীবী তারাই যারা তাদের দেয়া বুদ্ধি, প্রজ্ঞা ও মনন দ্বারা আগামীর বিশ্বকে স্বপ্ন দেখায়। বুদ্ধিজীবী হচ্ছে তারাই যারা বর্তমান সময়ে সমকালীন অর্থনীতি ও রাজনীতিকে পরিবর্তন করার মত চিন্তা করেন। আর তারা চিন্তা করেন বিধায় তাদেরকে সবসময় ক্ষমতাসীনদের রোষানলে পড়তে হয়। মাননীয় উপ-উপাচার্য ১৯৭১ সালে বাঙ্গালি জাতি যখন বিজয়ের দ্বারপ্রান্তে এবং লক্ষ লক্ষ পাকিস্তানী যখন বাংলাদেশ ত্যাগ করে পালানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে, এমন সময়ে কোন আন্তর্জাতিক চক্রান্তের কারণে আমাদের বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করা হয়েছে কি না, তা খতিয়ে বের করতে আন্তর্জাতিক কমিশন গঠন করার জন্য বর্তমান সরকারের কাছে অনুরোধ জানান।
মাননীয় উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) প্রফেসর ড. মোঃ কামাল উদ্দিন বলেন, পৃথিবীর বড় বুদ্ধিজীবী সক্রেটিস। যারা সত্য কথা বলে, ন্যায়ের কথা বলে, তারাই প্রকৃত বুদ্ধিজীবী। পাকিস্তানিরা পরিকল্পিভাবে আমাদের বুদ্ধিজীবীদেরকে হত্যা করেছে।তিনি আরও বলেন, আমাদের সম্মানিত শিক্ষকরা নিরপেক্ষতার অবস্থান হারিয়েছে। বাংলাদেশকে রক্ষার ক্ষেত্রে আজ আমরা বিভক্ত। তিনি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র ও গণআন্দোলনে অংশ নেয়া শিক্ষকদেরকে কৃতজ্ঞতার সাথে স্মরণ করেন। তিনি গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ বিনির্মাণে দলমত নির্বিশেষে সকলকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে ন্যায়ের কথা বলার আহবান জানান।
আলোচনা সভার সভাপতি ও চবি রেজিস্ট্রার প্রফেসর ড. মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম বলেন, শহিদ বুদ্ধিজীবী দিবস থেকে শেখার অনেক কিছু রয়েছে। শহিদদের জীবনের বিনিময়ে এ দেশ স্বাধীন হয়েছে। তিনি আরও বলেন, স্বৈরশাসক দীর্ঘ সময় ধরে আমাদের ঘাড়ে চেপে বসেছিল। আবু সাঈদসহ অনেকে বুক পেতে দিয়েছিল বলেই এ দেশ পুনরায় স্বাধীন হয়েছে। তিনি বলেন, গণতান্ত্রিক দেশে আমরা অনেকেই হতে পারি আওয়ামী লীগ, বিএনপি বা জামাত ইসলামীর সমর্থক। মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী দল আওয়ামী লীগের সদস্য হতে পারেন, কিন্তু তাই বলে আপনি ফ্যাসিবাদ বা স্বৈরাচারীর সমর্থক হতে পারেন না, বিবেকহীন হতে পারেন না, দায়িত্বহীন হতে পারেন না। তিনি ফ্যাসিবাদ সমূলে উৎখাত না হওয়া পর্যন্ত সকলকে সজাগ থাকার আহবান জানান।
চবি বিজ্ঞান অনুষদের ডিন প্রফেসর ড. মোহাম্মদ আল আমীন বলেন, ‘পাকিস্তানি হায়েনারা এদেশের বিজয় সুনিশ্চিত জেনে দেশের বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করেছিল। আমার বাবা একজন সরকারি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা হাওয়ায় তারা সেদিন তাকে তুলে নিয়ে গিয়েছিল, সাথে আরও দুইজন সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকেও তুলে নিয়েছিল তারা। একজন জেলা প্রশাসক অন্যজন সিইও। কিন্তু পরবর্তীতে সৌভাগ্যক্রমে আমার বাবা ফিরে আসলেও ওই দুজন কর্মকর্তা আর ফিরে আসেনি। তাদেরকে মেরে ফেলা হয়েছিল। তিনি নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণে নিজ নিজ অবস্থানে থেকে সকলকে একযোগে কাজ করার আহ্বান জানান।
আলোচনা অনুষ্ঠানের সঞ্চালক ও চবি প্রক্টর প্রফেসর ড. তানভীর মোহাম্মদ হায়দার আরিফ বলেন, দীর্ঘ সাড়ে পনেরো বছর ফ্যাসিবাদ সরকার এ দেশের সাধারণ মানুষের ওপর জুলুম চালিয়েছিল। তাদের সেই জুলুমের কারণে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতা ফ্যাসিবাদী সরকারকে পতন করতে বুক পেতে দিয়েছিল। এরইমধ্যে অর্জিত হয় নতুন বাংলাদেশ। তিনি ছাত্র সমাজ তথা তরুণ প্রজন্মকে নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণে অতন্ত্র প্রহরীর মত সজাগ থেকে নিজ নিজ অবস্থানে কাজ করার আহ্বান জানান।
আলোচনা সভায় অন্যান্যদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন চবি শাহ আমানত হলের প্রভোস্ট প্রফেসর ড. মোঃ গোলাম কিবরিয়া, চবি পদার্থবিদ্যা বিভাগের সভাপতি সভাপতি প্রফেসর ড. মোঃ রফিকুল ইসলাম, চবি ছাত্র-ছাত্রী পরামর্শ ও নির্দেশনা পরিচালক ড. মোঃ আনোয়ার হোসেন, চবি অফিসার সমিতির সভাপতি, জনাব রশিদুল হায়দার জাবেদ, চবি ক্লাব (ক্যাম্পাস) এর সম্পাদক জনাব মোহাম্মদ মঞ্জুর মোর্শেদ, চবি কর্মচারী সমিতির সভাপতি জনাব মোঃ মনছুর আলী ও চবি কর্মচারী ইউনিয়নের সভাপতি জনাব মোহাম্মদ আলী হোছাইন। সভায় শহিদ বুদ্ধিজীবী ও অন্যান্য শহিদদের রুহের মাগফেরাত কামনা করে দোয়া ও মোনাজাত পরিচালনা করেন চবি তথ্য ও ফটোগ্রাফি শাখার প্রশাসক ড. মোঃ শহীদুল হক। অনুষ্ঠানে শহিদদের সম্মানে দাঁড়িয়ে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়।পুস্পস্তবক অর্পণ করে দেশ-জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান শহিদ বুদ্ধিজীবীদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন কার্যক্রম পরিচালনা করেন চবি তথ্য ও ফটোগ্রাফি শাখার ডেপুটি রেজিস্ট্রার জনাব মোহাম্মদ হোসেন।
শহিদ বুদ্ধিজীবী দিবসের কর্মসূচির অংশ হিসেবে সকালে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভবনসমূহে জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত রাখা হয় এবং কালো পতাকা উত্তোলন করা হয়। ফজরের নামাজের পর বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল মসজিদে শহিদ বুদ্ধিজীবীদের রুহের মাগফেরাত কামনা করে বিশেষ মোনাজাত ও অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের স্ব স্ব উপাসনালয়ে শহিদ বুদ্ধিজীবীদের আত্মার সদগতি কামনা করে প্রার্থনা করা হয়। এছাড়া শহিদ বুদ্ধিজীবী দিবসে কালো ব্যাজ ধারণ করা হয়।