মৌলভীবাজারের মিথ্যা তথ্য দিয়ে ৬ কোটি টাকার পেনশন ভাতা উত্তোলন

রাজন হোসেন তৌফিকুল, মৌলভীবাজার প্রতিনিধি:
মৌলভীবাজারের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা মিথ্যা তথ্য দিয়ে ৬ কোটি টাকার পেনশন উত্তোলন করেছেন। প্রতি মাসে নিচ্ছেন পেনশন ভাতাও।
জাতিগড়ার কারিগর শিক্ষকদের এমন মিথ্যাচারে হতবাক জেলার সচেতন মহল।
এসব শিক্ষককে আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করছেন জেলার সর্বস্তরের মানুষ। অনুসন্ধানে জানা যায়, ২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত শারীরিক অক্ষমতা দেখিয়ে পেনশনে যান জেলার বিভিন্ন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ৪৪ জন শিক্ষক।
প্রত্যেকেই নিজেকে অসুস্থ ও মানসিক ভারসাম্যহীন দেখিয়েছেন। অসুস্থতার কারণে নিয়মিত পাঠদান করাতে পারছেন না। অথচ তাদের কেউই প্রকৃতপক্ষে অসুস্থ ছিলেন না। পেনশন নিয়ে সবাই উন্নত দেশে পাড়ি জমিয়েছেন। অনুসন্ধান বলছে, শিক্ষকরা হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার থেকে অসুস্থতার কাগজপত্র সংগ্রহ করেন।
পরবর্তীতে বড় অঙ্কের টাকার বিনিময়ে জেলা সিভিল সার্জন অফিসের মেডিকেল বোর্ড ও জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তাকে ম্যানেজ করে পেনশনের আবেদন মঞ্জুর করান। জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিস সূত্রে জানা যায়, বিগত সাড়ে ৪ বছরে শারীরিক অক্ষমতাজনিত কারণে মৌলভীবাজারের ৪৪ জন শিক্ষক অবসরে যান।
এর মধ্যে প্রধান শিক্ষক দুজন। অন্যরা সহকারী শিক্ষক। অবসর নিয়ে তারা উন্নত দেশে পাড়ি জমিয়েছেন। এদের মধ্যে সদর উপজেলার লাকী ভট্টাচার্য, মো. আব্দুল হাদী ও ফাতেমা বেগম ইউএসএ, জাহানারা ইয়াসমিন, মো. মশিউর রহমান, রেজা বেগম ও বনানী পাল কানাডা এবং সুলতানা বেগম ইউকে বসবাস করছেন।
বড়লেখা উপজেলার সাজেদা আলম, হেনা বেগম, প্রণত রঞ্জন বৈদ্য, ইমিলি রানী দাস, রহিমা বেগম, পুষ্পা রানী দাস বর্তমানে কোন দেশে বসবাস করছেন জানা যায়নি। রাজনগর উপজেলার অনুঢ়া মালঞ্চ, মো. মুহিতুর রহমান ও হালিমা আক্তার ইউকে, রীতা রানি দাস পর্তুগাল এবং নিবেদিতা রায় কানাডায় বসবাস করছেন। মনোয়ারা বেগম, স্বর্ণা ধর ও স্বর্ণা ভট্টাচার্যের বর্তমান অবস্থান নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
কুলাউড়া উপজেলার মাসুমা খাতুন কানাডা ও নুরুল ইসলাম ইউকে বসবাস করছেন। রাশেদা আক্তার, সাবেরা সুলতানা চৌধুরী, দীপক চন্দ্র ধর, আঁখি দাস, রোকেয়া বেগম ও আব্দুর রহিম কোন দেশে বসবাস করছেন জানা যায়নি।
শ্রীমঙ্গল উপজেলার হেপী রাণী দেব কানাডায় বসবাস করছেন। বাকি তাহমিদা খানম, খেলন রাণী রায়, সুমা রানী কর, ব্রিশিতা পাল, ফরিদা ইয়াসমিন বাপ্পি, সম্পা রাণী দেব, নীলাশ্রী দেব, কান্তা রাণী রায় ও তুলী রাণী ধরের অবস্থান নিশ্চিত হওয়া যায়নি। কমলগঞ্জ উপজেলায় শিউলী রাণী পাল অবস্থান করছেন ইউএসএ।
জেলার সংশ্লিষ্ট উপজেলা হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তাদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ৪২ জন শিক্ষক বিগত সাড়ে ৪ বছরে অক্ষমতাজনিত পেনশন উত্তোলন করেছেন ৫ কোটি ৭৩ লাখ ১৭ হাজার ৪৭ টাকা।
ওইসব শিক্ষক প্রবাসে থেকেও প্রতি মাসে পেনশন পাচ্ছেন আড়াই লাখ টাকার উপরে। মৌলভীবাজার সদর উপজেলার পদুনাপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সদ্য সাবেক প্রধান শিক্ষক নির্মল কান্তি দত্ত বলেন, সহকারী শিক্ষক মো. মসিউর রহমান অক্ষমতাজনিত কারণে ছুটি নিয়ে সপরিবারে কানাডায় চলে গেছেন।
মোস্তফাপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সৈয়দা নাদিরা হোসেন বলেন, সহকারী শিক্ষক ফাতেমা বেগম পেনশন নিয়ে আমেরিকা চলে গেছেন।
ফাতেমা বেগম কী খুব বেশি অসুস্থ ছিলেন? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, উনার মেয়েলি কিছু সমস্যা ছিল এবং নিয়মিত বিদ্যালয়ে দেরিতে আসা-যাওয়া করতেন। কমলগঞ্জ উপজেলার বেগম জেবুন্নেছা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক নার্গিস আক্তার বলেন, শিউলী রাণী পাল অসুস্থ দেখিয়ে প্রথমে ১০ দিনের ছুটি নিয়ে আমেরিকায় যান।
৮ মাস ধরে কর্মস্থলে অনুপস্থিত থাকায় কর্তৃপক্ষ উনার বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা করে। পরবর্তীতে দেশে এসে বিভিন্ন জায়গায় দৌড়াদৌড়ি করে অক্ষমতাজনিত পেনশন নিয়ে আবার আমেরিকা চলে যান। তবে তিনি অসুস্থ ছিলেন না।
রাজনগর উপজেলার মহাদেবী বড়কাপন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. আব্দুল হান্নান বলেন, স্বর্ণা ভট্টাচার্য ও নিবেদিতা রায় শারীরিক অসুস্থতা দেখিয়ে ছুটি নিয়ে কানাডা চলে গেছেন। আদৌও কী তারা অসুস্থ ছিলেন, এমন প্রশ্নের জবাবে প্রধান শিক্ষক বলেন, তারা অসুস্থ ছিলেন না। তবে তারা মেডিকেল সার্টিফিকেট কিভাবে নিলেন আমি বলতে পারছি না।
শিক্ষক নেতারা বলেন, সুস্থ থাকার পরও অনেক অক্ষমতাজনিত পেনশন নিয়েছেন। তদন্ত করে এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন। জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা শফিউল আলম বলেন, শারীরিক অক্ষমতা ঘোষণা করার একমাত্র দায়িত্ব সিভিল সার্জনের। এসব শিক্ষক সুস্থ হয়ে কিভাবে অক্ষমতাজনিত পেনশন পেল বিষয়টি খোঁজখবর নিয়ে দেখতে হবে।
পেনশনের টাকা কি ফেরত এবং পেনশন ভাতা বন্ধ করার সুযোগ আছে কিনা, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আইনে কি আছে সেটা দেখতে হবে। সিভিল সার্জন ডা. মো. মামুনুর রহমান বলেন, তদন্ত করে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করব। ইনভেলিট না হয়েও ইনভেলিট হলে তাদের পেনশন বাতিল করা হবে। তবে যারা এই কাজ করেছেন মোটেও ঠিক করেননি।