সাগরে প্লাস্টিক বর্জ্য না ফেলতে পাথরঘাটার জেলেদের কাছে খোকনের সচেতনতা

ইব্রাহীম খলীল, পাথরঘাটা।
কখনো সাংবাদিক, কখনো মানবিককর্মী, কখনো সামাজিক আন্দোলনকর্মী কখনো উপকূল বন্ধু, কখনো বা পরিবেশ-জলবায়ুযোদ্ধা হিসেবে পরিচিত মুখ শফিকুল ইসলাম খোকন।
খোকন একজন গণমাধ্যকর্মী। সাংবাদিকতা পেশায় থেকেও ভিন্নধর্মী কাজ করা যায় তার উদাহরণ তিনি। রোগিদের জন্য রক্ত সংগ্রহ করা, অর্থের অভাবে চিকিৎসা না পাওয়া রোগিদের চিকিৎসার সাহায্যে এগিয়ে আসা, পথচারীদের খাবার দেয়া,তরুণদের সামাজিক কাজে সম্পৃক্ত করা, মানবিক কাজ করা, সামাজিক আন্দোলনসহ নানা কাজে পাওয়া যায় তাকে।
বর্তমানে শফিকুল ইসলাম খোকন উপকূলের পরিবেশ রক্ষা এবং জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে কাজ করে যাচ্ছেন বিরামহীন। প্রথম হিউম্যানবুক হিসেবে স্বীকৃতিপ্রাপ্ত শফিকুল ইসলাম খোকন সামুদ্রিক প্রোটিন, জীবন-জীবিকা, পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা সহ সমুদ্র অর্থনীতি টিকিয়ে রাখতে সাগরে জেলেদের প্লাষ্টিক বর্জ না ফেলতে সেচ্ছায় সচেতন করছেন। দীর্ঘদিন ধরে তিনি পাথরঘাটার বৃহত্তম মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রের ঘাটে এবং বিভিন্ন খালে নোঙর করা সমুদ্রগামী মাছ ধরা ট্রলারের জেলেদের এমন সচেতন করছেন।
উপকূলের জেলেরা তাদের জীবন-জীবিকার জন্য গভীর সমুদ্রে মাছ শিকার করতে যায়। এক একটি মাছ ধরা ট্রলারে ১৫ থেকে ২০ জন জেলে থাকেন এবং তারা ১০ থেকে ১৫ দিন গভীর সমুদ্রে অবস্থান করেন। এ সময় তাদের ব্যবহৃত কোমলপানীয়র বোতল, কসমেটিকসের মোড়ক, নিত্যব্যবহার্য বিভিন্ন পণ্যসহ পলিথিন ব্যাগ সাগরে ফেলছে। যার কারণে সমুদ্রের তলদেশে প্লাষ্টিক বর্জ্য জমে থাকায় সামুদ্রিক প্রোটিনের ব্যপক ক্ষতি হচ্ছে পাপাশাশি পরিবেশের ভারসাম্যও হারাচ্ছে। দিন দিন তা পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক হুমকির কারণ হয়ে দেখা দিচ্ছে। ক্ষতিকারক জেনেও মানুষের মধ্যে দিন দিন পলিথিন ও প্লাস্টিকসামগ্রীর ব্যবহার এবং অব্যবস্থাপনার হার ক্রমেই বাড়ছে। সাগরে জেলে সম্প্রদায়ই বেশি অবস্থান করার কারণে সমুদ্রগামী জেলেদের সাগরে যত্রতত্র প্লাষ্টিকের বর্জ যাতে না ফেলে এজন্যই এই ব্যতিক্রমই উদ্যোগ নিয়েছেন শফিকুল ইসলাম খোকন।
এ পর্যন্ত তিনি অন্তত ৫০টির বেশি মাছ ধরা ট্রলারের জেলেদের সাগরে প্লাষ্টিকের বর্জ ফেলায় ক্ষতিকর দিকগুলো তুলে ধরেছেন এবং সমুদ্র অর্থনীতি তথা সমুদ্রে মাছসহ প্রাকৃতিক সম্পদের বিষয় তিনি হাতে কলমে বুঝিয়ে দিচ্ছেন। জেলেরা সাগর থেকে মাছ শিকার করে ঘাটে আসা মাত্রই ছুটে যান তিনি। জেলেরা সাগরে থাকাবস্থায় ট্রলারে বস্তা, ড্রাম বা ঝুড়িতে ব্যবহৃত প্লাষ্টিকের মালামাল সংরণ করে কুলে এসে নির্ধারিত জাযগায় ফেলতে উদ্ভুদ্ধ করছেন তিনি। শফিকুল ইসলাম খোকন পরিবেশ ও জলবায়ু বিষয়ক নাগরিক সংগঠন ধরিত্রী রক্ষায় আমরা (ধরা) এর সাথে সম্পৃক্ত রয়েছেন, পাশাপাশি স্থানীয় তরুণদের সংগঠিত করতে পরিবেশ রক্ষায় ‘পাথরঘাটা উপকূল সুরক্ষা আন্দোলন’ নামে একটি সংগঠন তৈরী করেন।
কথা হয় শফিকুল ইসলাম খোকনের সঙ্গে। তিনি বলেন, বাণিজ্যিক জাহাজের পাশাপাশি সমুদ্রে হাজার হাজার মাছ ধরা ট্রলার থাকে। এসব ট্রলারের জেলেরা প্রতি ট্রিপেই কোন না কোনভাবে প্লাস্টিক নিয়ে যাচ্ছে যা সমুদ্রেই ফেলে দিচ্ছে। এতে করে হুমকির মুখে সমুদ্র, এ রকম চলতে থাকলে এক সময় থাকবে না আর কোনো সামুদ্রিক মাছ। অতিরিক্ত মাছ ধরা, জলবায়ু পরিবর্তন এবং প্লাস্টিকের দূষণের কারণে বিশ্বের সাগর-মহাসাগর এখন হুমকির মুখে৷
কিভাবে এই ব্যতিক্রম কাজে আসা এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, দীর্ঘদিন ধরে জলবায়ু পরিবর্তন এবং পরিবেশ নিয়ে কাজ করে যাচ্ছি। পাশাপাশি সাংবাদিকতার পেশার কারণে অনেক সময় মানুষের কাছে যেতে হয় তথ্য অনুসন্ধান করতে হয়। জেলেদের কাছ থেকে দেখেছি তারা কতটা প্লাস্টিক ব্যবহার করছে সাগরে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে উপকূলের পাশাপাশি সমুদ্রও ঝূকিতে রয়েছে। তাছাড়া প্লাস্টিক বজ্য ফেলার কারণে আরও ক্ষতির সম্মুখিন সমুদ্রসহ সামুদ্রিক সম্পদ। সমুদ্রগামী জেলেদের এ ক্ষেত্রে ভূমিকা রয়েছে, এ কারণেই আমি জেলেদেরকে বেছে নিয়েছি। জেলেরা যেমন আমাদের সম্পদ, এ সম্পদকেই কাজে লাগানো যায়। তাদের সচেতন করতে পারলে হয়তো বা একদিন সমুদ্রে প্লাস্টিক ফেলা বন্ধ হবে। ইতোপুর্বে আমি বেশ কয়েকটি ট্রলারে প্লাস্টিক রাখার জন্য নির্ধারিত জায়গা করে দিয়েছি, যাতে করে সাগরে না ফেলে কুলে এসে নির্ধারিত জায়গায় ফেলে তারা। কতটুকু সফল হবো জানি না, তবে এগিয়ে যাচ্ছি। জেলেদের পাশাপাশি ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য সাগরকে রা করার বিভিন্ন পদপে নেয়ার পরামর্শ দেন তিনি।
গভীর সমুদ্রে মাছ শিকার করা জেলে আবদুল কাদের, বেলায়েত হোসেন, জাহাঙ্গীর মাঝিসহ একাধিক জেলেরা বলেন, সাগরে যখন মাছ ধরতে যাই, তখন আমাদের সাথে অনেক প্লাস্টিক, পলিথিন থাকে। ওইগুলো ব্যবহার শেষে সাগরেই ফেলে দিয়ে আসি। এর ক্ষতিকর বিষয় আমরা জানতাম না। তবে সাংবাদিক খোকন প্রায়ই আমাদের কাছে এসে সাগরে প্লাস্টিক নিয়ে যেতে নিষেধ করেন। প্রথমে আমরা তার কথাগুলো হাস্যকর হিসেবে নিতাম। পরে যখন তার কথায় ক্ষতিকর বিষয় বুঝতে পারলাম তখন থেকেই সচেতন হলাম।
তারা আরও বলেন, সাগরমুখি জেলেরা যদি প্লাস্টিক ব্যবহার বন্ধ করে তাহলে সাগর অনেকটা ভালো থাকবে। যেহেতু আমাদের জীবিকা সাগরের ওপর নির্ভর, আমাদেরকেই রক্ষা করতে হবে। আমরাও চেষ্টা করছি সাগরে প্লাস্টিক না নেওয়ার। খোকন ভাইয়ের দেয়া বক্সে প্লাস্টিক রাখছি, যা কুলে এসে নির্ধারিত জায়গায় ফেলে দেই।
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মনোজ কুমার কীর্তনীয়া বলেন, এটি অবশ্যই ব্যতিক্রম কাজ। সাগর এখন ধংসের পথে। আর এ পথ থেকে রক্ষা করতে পারে জেলেরাই। খোকনের এমন কাজকে স্বাগত জানাই পাশাপাশি তার এ কাজ সমাজ এবং রাষ্ট্রও কাজে লাগাতে পারে।
বরগুনা জেলা মৎস্যজীবী ট্রলার মালিক সমিতির সভাপতি গোলাম মোস্তফা চৌধুরী বলেন, সাগরে প্রতিদিনই অসংখ্য ট্রলার মাছ শিকার করতে যায়। প্রতিটি ট্রলারেই জেলেরা প্লাস্টিক নিয়ে যায়, যা সাগরেই ফেলে দিয়ে আসে। প্লাস্টিক সাগরে ফেলার কারণে লাভ তি জেলেরা হিসাব করে না। তবে আমরা যতটা জানতে পেরেছি সাগরে প্লাস্টিকের কারণে সামুদ্রিক মাছসহ সাগরের অনেক তি হয়। জেলেরা আসলে এ বিষয় সচেতন নয়।