সারাদেশ

জামালপুরে ঢাকঢোল পিটিয়ে ৭ পরিবারকে ‘সমাজচ্যুতি’, ক্ষমা চাইলেন সেই সালিশকারীরা

ফারিয়াজ ফাহিম
জামালপুর

জামালপুর সদর উপজেলার দাপুনিয়া গ্রামে মধ্যযুগীয় কায়দায় ঢাক-ঢোল পিটিয়ে এবং মাইকিংয়ের মাধ্যমে সাতটি পরিবারকে সমাজচ্যুত ঘোষণা করার ঘটনার পর ব্যাপক তোলপাড় শুরু হয় স্থানীয়ভাবে। ওই ঘটনার দুই দিন পর গ্রামবাসীর চাপে ও প্রশাসনের কড়া অবস্থানের মুখে নিজেদের অন্যায় স্বীকার করে প্রকাশ্যে ক্ষমা চেয়েছেন সালিশকারী মাতাব্বররা।

আজ সোমবার (১৬ জুন) সন্ধায় বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন জামালপুরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ইয়াহিয়া আল মামুন।। আজ সকাল থেকে পরিবারগুলো আবারও আগের মতো স্বাধীনভাবে চলাফেরা শুরু করেছে।

এর আগে রোববার (১৫ জুন) রাতে দাপুনিয়া সমাজ উন্নয়ন সংগঠনের কার্যালয়ে এক বৃহৎ সভায় শতাধিক গ্রামবাসীর উপস্থিতিতে সালিশকারীরা নিজেদের দোষ স্বীকার করে সমাজচ্যুত পরিবারের কাছে প্রকাশ্যে ক্ষমা চান। একই সঙ্গে মাইকে আবার ঘোষণা দিয়ে আগের অন্যায় সিদ্ধান্ত বাতিল করেন তারা।

ঘটনাটি ১৩ জুন (শুক্রবার) রাতে ঘটে।জানা যায়, একটি তুচ্ছ ঘটনা—দুই প্রতিবেশীর মধ্যে বাকবিতণ্ডা—কে কেন্দ্র করে রাতেই বসে এক ‘সালিশি বৈঠক’। সেই বৈঠকে দাপুনিয়া গ্রামের শামীম আহমেদ, আমিনুল ইসলাম, আব্দুল ওয়াদুদ বানু, মিন্টু মিয়া, মোছা. আমেনা বেগমসহ আরও কয়েকজন কর্তৃত্বপরায়ণ ব্যক্তি উপস্থিত ছিলেন।

বৈঠকে মো. মুনছুর মিয়ার বিরুদ্ধে ৫০ হাজার টাকা দাবি করা হয়। কিন্তু তিনি ওই টাকা দিতে অপারগতা প্রকাশ করলে রাত ১১টার দিকে ঢাক-ঢোল পিটিয়ে এবং মাইকে ঘোষণা দিয়ে পুরো গ্রামে সাতটি পরিবারকে সমাজচ্যুত ঘোষণা করে দেওয়া হয়।

এতে বলা হয়, এসব পরিবারের সদস্যরা মসজিদে নামাজ পড়তে পারবে না, দোকানপাটে কেনাকাটা করতে পারবে না, স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসায় যাওয়া নিষিদ্ধ এবং প্রকাশ্যে চলাফেরা করলে ‘বাড়িঘর পুড়িয়ে দেওয়ার’ মতো ভয়াবহ হুমকিও দেওয়া হয়।

এ ঘটনাকে ঘিরে এলাকায় চরম উত্তেজনা দেখা দিলে পরদিন (১৪ জুন) দাপুনিয়া গ্রামের ভুক্তভোগী ইসমাইল মৌলভী জামালপুর সদর থানায় একটি লিখিত অভিযোগ দায়ের করেন। এতে নির্দিষ্টভাবে সাত-আটজনের নাম উল্লেখ করা হয় এবং আরও কয়েকজনকে অজ্ঞাত হিসেবে অভিযুক্ত করা হয়।

অভিযোগ পাওয়ার পরপরই প্রশাসন ঘটনাস্থলে যায় এবং পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে কড়া বার্তা দেয়—রোববারের (১৫ জুন) মধ্যে সমস্যার সমাধান না হলে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

প্রশাসনের হুঁশিয়ারির পর রোববার রাত ১০টার দিকে আবার বৈঠক বসে। এই বৈঠক হয় দাপুনিয়া সমাজ উন্নয়ন সংগঠনের কার্যালয়ে। সেখানে গ্রামের শত শত মানুষ, গণ্যমান্য ব্যক্তি ও আইনজীবীদের উপস্থিতিতে সালিশকারীরা নিজেদের ভুল স্বীকার করে সাত পরিবারকে একঘরে করে রাখার সিদ্ধান্ত বাতিল করেন এবং প্রকাশ্যে ক্ষমা চান।

আইনজীবী আনিছুর রহমান মানিক জানান, “ঘটনাটি ছিল সামাজিক নিপীড়নের এক নির্মম দৃষ্টান্ত। তবে সালিশকারীরা ভুল বুঝতে পেরে ক্ষমা চাওয়ায় একটি সংঘাত এড়ানো গেছে। তারা প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, আর কখনো এমন অন্যায় করবেন না।”

ওই রাতেই আবার মাইকিং করে আগের সিদ্ধান্ত বাতিলের ঘোষণা দেওয়া হয়। বলা হয়, ভুক্তভোগী পরিবারগুলো যেন নির্বিঘ্নে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যেতে পারে।

ইসমাইল মৌলভীর ছেলে মৌকিব হোসেন বলেন, “আমাদের আতঙ্কের মধ্যে রাখা হয়েছিল। এমনকি রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাওয়ারও স্বাধীনতা ছিল না। এখন তারা প্রকাশ্যে ক্ষমা চেয়েছে—আমরা স্বস্তি বোধ করছি। তবে এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি যেন না হয়, প্রশাসনকে তা নিশ্চিত করতে হবে।”

এ বিষয়ে মানবাধিকার কর্মী জাহাঙ্গীর সেলিম বলেন, “এই ঘটনা প্রমাণ করে যে এখনো অনেক এলাকায় আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়ার প্রবণতা রয়েছে। রাষ্ট্র ও প্রশাসনের উচিত এমন ঘটনায় জড়িতদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা।”

জামালপুরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ইয়াহিয়া আল মামুন বলেন, “আমরা অভিযোগ পাওয়ার পরপরই বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছি। ভুক্তভোগীদের পাশে দাঁড়িয়েছি। সালিশকারীরা নিজেরা স্বীকারোক্তিমূলকভাবে ক্ষমা চেয়েছেন। তারপরও ওই এলাকায় পুলিশের নজরদারি অব্যাহত থাকবে। ভবিষ্যতে কেউ যেন এমন দুঃসাহস না দেখায়—সেজন্য আইনানুগ প্রস্তুতি রাখা হচ্ছে।”

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

You may also like

সারাদেশ

বদলে যাচ্ছে র‌্যাব: পরিবর্তন হচ্ছে নাম, লোগো ও পোশাক

নতুন রূপে আসছে র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব)। এ বাহিনীর নাম, লোগো ও পোশাক পরিবর্তনের পরিকল্পনা করা হয়েছে। শুধু তা-ই নয়,
সারাদেশ

আইনপুর গ্রামে পরিতোষ , সন্তোষ বাড়িতে অগ্নিকাণ্ডে দুর্ঘটনা ঘটে

মৌলভীবাজার প্রতিনিধিঃ মৌলভীবাজার সদর উপজেলার আইনপুর গ্রামের পরিতোষ সূত্রধর ও সন্তোষ সূত্রধর বাড়িতে আগুনে দুর্ঘটনা ঘটেছে। গত বুধবার ০৭/০৮/২৪ ইং