শিক্ষাঙ্গন

ভর্তি পরীক্ষার একদিন 

মিজানুর রহমান, ইবি প্রতিনিধি:

রোদে ঝলমলে সকাল, যেন আকাশের মনটাও আজ ফুরফুরে। মনে রাজ্যের আশা নিয়ে অগণিত স্বপ্নবাজের দল এসে জুটেছে তাদের স্বপ্নপূরণের আখড়ায়। আজ ১৯টি বিশ্ববিদ্যালয়ের মানবিক বিভাগের ভর্তি পরীক্ষা। ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে যেন স্বপ্নসন্ধানীদের মেলা বসেছে, প্রায় সাত হাজার পরীক্ষার্থী, সকলের মনে একটাই মন্ত্র – “একটা সিট আমার চাই!”

এই একটা সিটের জন্য কত রাতের ঘুম হারাম, কত ইচ্ছের বলিদান! যখন বন্ধু-বান্ধবরা খেলা-ধুলায় মত্ত, এরা তখন বইয়ের পাতায় মুখ গুঁজে, যেন শরৎচন্দ্রের ‘শ্রীকান্ত’র সেই উদাসীন বালক – জগৎ সংসারের চেয়ে ব্যাকরণের বাঁধুনিই তাদের বেশি টানে। কেউ হয়তো ভাবছে, “ধুর বাবা, জীবনটা পানসে হয়ে গেল!” কিন্তু তাদের চোখে তো অন্য স্বপ্ন, অন্য নেশা।

বাবা-মায়ের চোখে কত আশা! তাঁদের আদরের দুলাল-দুলালী একদিন বিশ্ববিদ্যালয়ের আঙিনা আলো করবে, গলায় ঝুলবে গ্র্যাজুয়েশনের তকমা। সেই স্বপ্নপূরণের ‘রণক্ষেত্রে’ আজ তাদের সন্তানেরা যোদ্ধা। এই দৃশ্য দেখলে মনে হয় যেন জীবনানন্দ দাশের কবিতার সেই লাইন – “বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি, তাই পৃথিবীর রূপ খুঁজিতে যাই না আর।” হ্যাঁ, এই তরুণরা যেন তাদের মা-বাবার মুখের দিকে তাকিয়েই সব ক্লান্তি ভুলে যায়।

তবে এই স্বপ্ন-যুদ্ধে কিছু স্পেশাল ফাইটারও আছে। এক তরুণ, যাঁর একটি পা নেই, মায়ের কাঁধে ভর দিয়ে এসেছে। দৃশ্যটা দেখে মনে হয় যেন হুমায়ূন আহমেদের নাটকের কোনো গভীর মুহূর্ত – যেখানে নীরবতাও কথা বলে। তাঁর এই লড়াই কি সহজ? নিশ্চয়ই নয়। তার সাথে কি কারো তুলনা হয়? কিন্তু তাঁর চোখে জীবনের নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন, যেন কাজী নজরুলের সেই বিপ্লবী আহ্বান – “আমরা চলিব পশ্চাৎ-পদে, ছাড়ি ত্রাস সঞ্চিত পথে।”

আরেকজন এসেছেন লাঠিতে ভর দিয়ে। শারীরিকভাবে অক্ষম আরও কতজন! কারও কোলে ঘুমন্ত শিশু, যেন মমতার বাঁধনও আজ পরীক্ষার হলের বাইরে অপেক্ষা করছে। আরেকজন এসেছেন এক চোখে স্বপ্ন নিয়ে, যেন তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের কোনো উপন্যাসের দৃঢ়চেতা নারী চরিত্র।

রাস্তার গ্যাঁড়াকলে পড়ে কয়েকজন পরীক্ষার্থী একটু দেরি করে এলেও, প্রক্টর সাহেবরা দেবদূতের মতো এসে তাদের হলে পৌঁছে দিচ্ছেন। কারও মুখে বিরক্তির লেশমাত্র নেই, সকলের মনে একটাই প্রতিজ্ঞা – “যুদ্ধে এসে পিছপা হব না!”

ক্যাম্পাসে আবার অন্য ছবি। বিএনসিসি আর স্কাউটের দল যেন সিনেমার হিরো, সকলের সাহায্যে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। পরীক্ষার্থীদের হল খুঁজে দেওয়া থেকে শুরু করে তাদের ব্যাগ-মোবাইল সামলানো – সব দায়িত্ব তাদের কাঁধে। গেটের বাইরে বিভিন্ন সামাজিক, অরাজনৈতিক দলও সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। কেউ দিচ্ছে ঠান্ডা পানি, কেউ শরবত, আবার কেউবা চকোলেট – যেন এক ভালোবাসার মেলা বসেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনও চেষ্টার ত্রুটি রাখেনি, যাতে পরীক্ষার্থীরা শান্ত মনে পরীক্ষা দিতে পারে।

পরীক্ষার হলগুলোতে পিনপতন নীরবতা, যেন সবাই ধ্যানমগ্ন ঋষি। আর বাইরে অভিভাবকেরা, কেউ সন্তানের মঙ্গল কামনায় নীরব প্রার্থনায় মগ্ন, কেউবা নিজেদের ছেলেবেলার পরীক্ষার স্মৃতি রোমন্থন করছে। মনে হয় যেন বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কোনো গল্পের শান্ত অথচ গভীর চিত্র।

পরীক্ষা শেষে প্রধান ফটকের সামনে এক অন্যরকম উত্তেজনা। বিশ্ববিদ্যালয় থিয়েটার আয়োজন করেছে ‘ক্যারেক্টার ডে’। ফিলিস্তিনের মানুষের কষ্টের কথা, তাদের মুক্তির আকাঙ্ক্ষার কথা নাটকের মাধ্যমে তুলে ধরছে তারা। পরীক্ষার্থীরা দেখছে, হয়তো ভাবছে – এই বিশ্ববিদ্যালয়ে শুধু পড়াই নয়, মানুষের জন্য ভাবারও জায়গা আছে।

আসলে, এই ভর্তি পরীক্ষাটা একটা যুদ্ধক্ষেত্রই বটে। সিট অল্প, কিন্তু প্রতিযোগী অনেক। খুব কম জনই সুযোগ পাবে স্বপ্নের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার। তবে চান্স পাওয়া না পাওয়া তো জীবনের শেষ কথা নয়। যেমন লালন সাঁই বলেছিলেন – “মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি।” আসল কথা হল, নিজেকে একজন ভালো মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। তাই, এই স্বপ্ন-কুস্তির আসরে যারা বিজয়ী হবে, তাদের জন্য রইল শুভকামনা। আর যারা সামান্যের জন্য পিছিয়ে পড়বে, তাদের জন্য একটাই কথা – জীবন কখনোই থেমে থাকে না। বরং, এই অভিজ্ঞতাকে সঙ্গী করে আরও শক্তিশালী হয়ে এগিয়ে যেতে হবে। কারণ, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষায় – “আলো আসবে, আলো আসবেই।” আর সেই আলোর পথেই একদিন দেখা হবে সাফল্যের সোনালী বন্দরে।

আজকের এই দিন- পরীক্ষাকেন্দ্রের প্রতিটি মুহূর্ত একদিন স্মৃতি হয়ে থাকবে তাদের জীবনে। জয় হোক বা না হোক, তারা যে স্বপ্ন দেখতে শিখেছে, সেটাই বড় পাওয়া। আর যারা আজ এই যুদ্ধে অংশ নিচ্ছে, তারাই তো আগামীর বাংলাদেশ গড়ার কারিগর। তাদের লড়াই, তাদের স্বপ্ন, একদিন সত্যিই আলোকিত করবে এই দেশকে।

 

You may also like

Uncategorized শিক্ষাঙ্গন

নাজিরপুরে শিক্ষক কর্মচারী ঐক্যজোটের ত্রি-বার্ষিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত

পিরোজপুর প্রতিনিধি :বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটি অন্যতম সদস্য, বাংলাদেশ শিক্ষক কর্মচারী ঐক্যজোটের বরিশাল বিভাগীয় সমন্বয়ক ও কেন্দ্রীয় কমিটির প্রেসিডিয়াম সদস্য অধ্যক্ষ
Uncategorized শিক্ষাঙ্গন সারাদেশ

পিরোজপুর ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের মতবিনিময়

পিরোজপুর প্রতিনিধি: ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যায়ের উপাচার্যের পিরোজপুরে আগমন উপলক্ষে সংবর্ধনা, আলোচনা ও মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে।শনিবার (৩০ নভেম্বর) সকালে পিরোজপুর