সারাদেশ

আইন আছে প্রয়োগ নাই, বেড়েই চলেছে নওগাঁয় উচ্চমাত্রার শব্দ দূষণ

নওগাঁ প্রতিনিধিঃ
২০০৬ সালের ৭ সেপ্টেম্বর গেজেটে জেলা পরিবেশ অধিদপ্তর শব্দ দূষণ নিয়ন্ত্রণে কী ভূমিকা রাখবেন, তার কোনো উল্লেখ নেই। দায়িত্ব দেওয়া আছে জেলা প্রশাসক ও ইউএনওকে। এদিকে প্রতিনিয়ত বাড়ছে শব্দদূষণে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলছেন, মানুষের কানে শব্দ গ্রহণের একটি মাত্রা আছে। শব্দের তীব্রতাকে মাপা হয় ডেসিবল দিয়ে। কানের যে অভ্যন্তরীণ অংশ, তা খুবই স্পর্শকাতর।
শব্দদূষণের মাত্রা নওগাঁয় মারাত্মকভাবে বেড়েই চলেছে। বিরম্বনায় পড়েছে শহরবাসী। শান্ত পরিবেশে মাত্রা যা গ্রহণ করা হয়, তা ৬০ ডেসিবল। যদি শব্দের মাত্র ৮০ ডেসিবলের উপরে গ্রহণ করতে হয়, তবে সেটা ধীরে ধীরে কানের স্পর্শকাতর অংশকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে শুরু করে। এই ক্ষতি সামান্য সময়ের জন্য নয়, এটি হয় স্থায়ী। সাধারণত মানুষ ৬০ বছর বয়সের পর কানে কিছুটা কম শোনে। কিন্তু এখন ৪৫ থেকে ৫০ বছর বয়সেই কানে কম শুনতে শুরু করেছে। এর সবকিছুই শব্দদূষণের প্রতিক্রিয়া। কানের অভ্যন্তরীণ স্পর্শকাতর অংশ, যাকে নার্ভ বলা হয়, তা যদি একবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তবে ফিরিয়ে আনা সম্ভব নয়।
অতিরিক্ত শব্দদূষণ শিশুসহ সব বয়সের মানুষের জন্য ক্ষতিকর। অতিরিক্ত শব্দ মানুষের মধ্যে অস্থিরতা, চঞ্চলতার বিরক্তির সৃষ্টি করে। অতিরিক্ত শব্দে মস্তিষ্কে বিরক্তির কারণ ঘটে। ফলে শ্রবণশক্তি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ধৈর্যশক্তি কমে যায়। মস্তিষ্কে চাপ সৃষ্টি হয়, কর্মক্ষমতা কমে যায়, মেজাজ খিটমিটে (ইরিটিবিটি) হয়ে যায়। মাথাব্যথা ভাব থেকে যায়। চিন্তাশক্তি ও বিশ্লেষণ ক্ষমতার (কগনেটিভ ফাংশন) উপর মারাত্মক প্রভাব পড়ে। শব্দ দূষণের কারণে রক্তের চাপ বেড়ে যায়। হার্ট অ্যাটাক ও স্ট্রোকের সম্ভাবনা থাকে। মানুষ যখন ধীরে ধীরে বার্ধক্যে পৌঁছে যায়, তখন পরিলক্ষিত হয় শব্দদূষণের মারাত্মক প্রভাব।
নওগাঁ শহরের মধ্যে ভারি যানবাহন না চললেও ব্যাটারিচালিত ইজিবাইকের তীব্র শব্দের ইলেকট্রনিক হর্ন আর উচ্চশব্দের সাইলেন্সার লাগানো বাইকের শব্দে অতিষ্ঠ নওগাঁ শহরবাসী। সাধারণের প্রশ্ন, এইসব নিয়ন্ত্রণের কি কেউ নেই? গেজেট বলছে কঠোর আইন আছে।
নওগাঁ তেতুলিয়া বিএমসি কলেজের অধ্যক্ষ সিদ্দিকুর রহমান বলেন, নওগাঁয় দূষণ যদি বলতে হয়, তবে বলবো এক নম্বরে আছে শব্দদূষণ। প্রতিদিন মাইকের শব্দে অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছি। এরা স্কুল, কলেজ, হাসপাতাল, সরকারি অফিস আদালত কিছুই মানে না। শব্দ দূষণ নিয়ন্ত্রণ করা খুব জরুরি।
নওগাঁ ফয়েজ উদ্দীন কলেজের ইংরেজির শিক্ষক আব্দুস সালাম বলেন, শব্দ দূষণ মানুষের জীবনে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সুস্থ জীবনকে করছে অসুস্থ। এটি একটি নিরব ঘাতকে পরিণত হয়েছে।
নওগাঁর বিশিষ্ট সাংস্কৃতিক কর্মী কায়েস উদ্দীন বলেন, শব্দ দূষণ রোধে আইন আছে, প্রয়োগ নাই। এটি যে কত বড় স্বাস্থ্য ঝুঁকির কারণ, যারা নিয়ন্ত্রণ করার দায়িত্বে আছেন, তারা গুরুত্ব দিচ্ছেন না।
স্থানীয় কলেজের দ্বাদশ শ্রেণীর ছাত্রী সাদিয়া বলেন, শব্দ দূষণ নওগাঁয় একটি বড় সমস্যা। অযথা যত্রতত্র উচ্চ শব্দে মাইক ও সাউন্ডবক্স বাজানো হচ্ছে। এতে পড়াশোনার সমস্যা হচ্ছে। পাশাপাশি অশান্তির সৃষ্টি হচ্ছে। সকলের শব্দ দূষণ রোধে এগিয়ে আসা উচিত।
আরেক ছাত্র সিবলী সাদিক বলেন, মাত্রারিক্ত শব্দ দূষণ চলছে নওগাঁয়। পড়াশোনার ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে। পড়াশোনায় মনোযোগের বিঘ্ন সৃষ্টি হচ্ছে। শহরের টাইলস মিস্ত্রী জাহাঙ্গীর জানান, সারাদিন টাইলসের কাজ করার পর কাজ শেষে কানে খুব কম শুনতে পান। এতে অপর জনের সাথে জোরে জোরে কথা বলার অভ্যাস হয়ে গেছে।
নওগাঁ সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়, নওগাঁ কেডি সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়, নওগাঁ জিলা স্কুলে পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের একাধিক অভিভাবকরা জানান, প্রতিদিন তাঁদের ছেলে-মেয়েদের নিয়ে স্কুলে আসেন। তাদের স্কুলে ঢুকিয়ে দিয়ে বাইরে অপেক্ষা করতে হয়। কিন্তু অসহ্য হয়ে পড়ে যখন একটির পর একটি মাইক উচ্চ শব্দে প্রচার করতে করতে স্কুলের সামনে দিয়ে যায়।
৭ সেপ্টেম্বর ২০০৬ সালে শব্দ দূষণ নিয়ন্ত্রণ বিধিমালা গেজেট আকারে প্রকাশিত হয়। যাতে উল্লেখ আছে নিরব এলাকায় দিনে ৫০, রাতে ৪০; আবাসিক এলাকায় দিনে ৫৫, রাতে ৪৫; মিশ্র এলাকায় দিনে ৬০, রাতে ৫০; বানিজ্যিক এলাকায় দিনে ৭০, রাতে ৬০; শিল্প এলাকায় দিনে ৭৫, রাতে ৭০ ডেসিবল মানমাত্রায় সাউন্ডে মাইকে প্রচার করা যাবে। ভোর ৬টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত দিবাকালীন সময় ও রাত ৯টা থেকে ভোর ৬টা পর্যন্ত রাত্রিকালীন সময় হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে। যা মানুষের শ্রবণান্দ্রিয়ের সাথে সম্পর্কিত শব্দের গড় মাত্রাকে বোঝাবে।
এই বিধি যেসব স্থান, ক্ষেত্রে প্রচার প্রচারনায় অনুষ্ঠানে প্রযোজ্য হবে না, যেমন রাষ্ট্রীয় কোনো দিবসে (স্বাধীনতা, ২১ ফেব্রুয়ারি, বিজয় দিবস, জাতীয় দিবস) অথবা সরকার কর্তৃক ঘোষিত কোনো গুরুত্বপূর্ণ দিবসে অনুষ্ঠান চলাকালে। মৃত্যু সংবাদ, কোনো ব্যক্তি নিখোঁজ থাকলে, গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ হারিয়ে গেলে, প্রাকৃতিক বিপর্যয় বা অন্য কোনো বিপদে বিপদ সংকেত প্রচারকালে, সরকারি বা সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানের গুরুত্বপূর্ণ তথ্য প্রচারকালে, প্রতিরক্ষা-পুলিশ বাহিনী ও আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী কর্তৃপক্ষের দাপ্তরিক কাজ সম্পাদনকালে, ইফতার ও শিহরির সময় প্রচারকালে, সরকার কর্তৃক সময় সময় অব্যাহতিপ্রাপ্ত অন্য কোনো কার্যক্রম সম্পাদনকালে, ধর্মীয় স্থান ও অনুষ্ঠানে।
নওগাঁ পরিবেশ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক মোঃ নাজমুল হোসাইন বলেন, ২০০৬ সালে শব্দদূষনের গেজেট প্রকাশের পর নতুন করে আর কোনো গেজেট প্রকাশিত হয়নি। সে সময় সব জেলায় পরিবেশ অধিদপ্তরের কার্যালয় ছিল না। কিন্তু এখন প্রায় সব জেলা কার্যালয় আছে। কিন্তু ২০০৬ সালে ৭ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত গেজেটে জেলা পর্যায়ের পরিবেশ অধিদপ্তরে অফিস শব্দ দূষণ নিয়ন্ত্রণে কী ভূমিকা রাখবে, তার বিশদ উল্লেখ নেই। তবে ২০০৬ সালে গেজেটে জেলা পর্যায়ে জেলা প্রশাসক ও উপজেলা পর্যায়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণের করণীয় বিষয়ে বলা আছে।
নওগাঁ মেডিক্যাল কলেজের সহযোগী অধ্যাপক (ইএনটি) ডাঃ মিলন কুমার চৌধুরী বলেন, ৬০ ডেসিবল শব্দমাত্র একটি সহনীয় পর্যায়ে থাকে। কিন্তু ৮০ বা তার চেয়ে বেশি উচ্চমাত্রার শব্দ মানুষের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। শিশুদের ক্ষেত্রে শব্দ দূষণ মারাত্মক ক্ষতিকারক। তাঁদের শ্রবণেন্দ্রিয় খুবই স্পর্শকাতর। উচ্চমাত্রার শব্দ একবার কানে প্রবেশ করলে কানের শব্দ গ্রহণের স্পর্শকাতর স্থানে এর ক্রিয়া চলমান থাকে। উচ্চমাত্রার শব্দ মস্তিষ্কে চাপ সৃষ্টি করে। চিন্তাশক্তি ও বিশ্লেষণ ক্ষমতার (কগনেটিভ ফাংশন) উপর মারাত্মক প্রভাব পড়ে। শব্দ দূষণের কারণে রক্তের চাপ বেড়ে যায়। হার্ট অ্যাটাক ও স্ট্রোকের সম্ভাবনা থাকে।
মানুষ যখন ধীরে ধীরে বার্ধক্যে পৌঁছে যায়, তখন পরিলক্ষিত হয় শব্দদূষণের মারাত্মক প্রভাব। সব সময় কানে যদি শোঁ শোঁ ভোঁ ভোঁ শব্দ হতে থাকে, যাকে চিকিৎসাবিজ্ঞানে টিনিটাস বলা হয়, যা এতোটাই ভংঙ্কর যে, এমন পরিস্থিতি থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য মানুষ আত্মহত্যাও করতে পারে। ব্যাটারিচালিত ইজিবাইক এক ধরনের হর্ণ ব্যবহার করছে, যার শব্দ ভীষণ তীব্র। যা সরাসরি কানের স্পর্শকাতর স্থানে আঘাত করে। নওগাঁ শহরে ৬০ থেকে ৯০ ডেসিবেল শব্দে নানা ভাবে শব্দ দূষণ চলছে। যা উচ্চমাত্রার শব্দদূষণ।
নওগাঁর জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আব্দুল আউয়াল বলেন, শব্দদূষণ অবশ্যই একটি বড় ধরনের সমস্যা। এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

You may also like

সারাদেশ

বদলে যাচ্ছে র‌্যাব: পরিবর্তন হচ্ছে নাম, লোগো ও পোশাক

নতুন রূপে আসছে র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব)। এ বাহিনীর নাম, লোগো ও পোশাক পরিবর্তনের পরিকল্পনা করা হয়েছে। শুধু তা-ই নয়,
সারাদেশ

আইনপুর গ্রামে পরিতোষ , সন্তোষ বাড়িতে অগ্নিকাণ্ডে দুর্ঘটনা ঘটে

মৌলভীবাজার প্রতিনিধিঃ মৌলভীবাজার সদর উপজেলার আইনপুর গ্রামের পরিতোষ সূত্রধর ও সন্তোষ সূত্রধর বাড়িতে আগুনে দুর্ঘটনা ঘটেছে। গত বুধবার ০৭/০৮/২৪ ইং