ভারতীয়দের বাঁধায় বাংলাদেশ অংশে ৫ মাস ধরে মনু প্রতিরক্ষা বাঁধে পাথরের ব্লকের কাজ বন্ধ; বর্ষায় সীমান্তবর্তী গ্রামগুলো প্লাবিত হওয়ার শঙ্কা

জায়েদ আহমেদ, মৌলভীবাজার প্রতিনিধি:
মৌলভীবাজারের কুলাউড়া উপজেলার শরীফপুর সীমান্তে মনু নদীর বাংলাদেশ অংশে ক্ষতিগ্রস্ত ও ঝুঁকিপূর্ণ মনু প্রতিরক্ষা বাঁধে পাথরের ব্লক স্থাপণের সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন হলেও ভারতীয় সীমান্ত রক্ষী বিএসএফের বাঁধা গত ৫ সাস ধরে ব্লক স্থাপণ করা যায়নি। পানি উন্নয়ন বোর্ড মৌলভীবাজারের ঢাকায় উচ্চ পর্যায়ের অবহিত করণে কলকাতায় যৌথ নদী কমিশনের বৈঠকেও এখন পর্যন্ত এ সমস্যার সমাধান হয়নি। এ অবস্থায় আগামী বর্ষায় উজানের ভারতীয় পাহাড়ি ঢলের পানি নেমে আসলে মনু নদীর পানিতে সীমান্তবর্তী বেশ কয়েকটি গ্রাম প্রভাবিত হওয়ার শঙ্কা রয়েছে। তবে এবার বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবির) বাঁধায় কৈলাশহর শ্মশান ঘাট এলাকার ভারতীয় অংশে মনু প্রতিরক্ষা বাঁধের কাজ গত ৫ দিন ধরে বন্ধ রয়েছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ড মৌলভীবাজার সূত্রে জানা যায়, গত বছর বন্যায় মৌলভীবাজার জেলার কুলাউড়া উপজেলার সীমান্তবর্থী শরীফুপুর ইউনিয়নে মনু নদীর প্রতিরক্ষা বাঁধের বেশ কয়েকটি স্থানে ভাঙ্গনও ঝুঁকিপূর্ণ স্থান রয়েছে। এসব এলাকা সরেজমিন পরিদর্শণ করে গত বছর থেকেই পাথরের ব্লক তৈরী করা শুরু হয়। পাথরের ব্লক তৈরী শেষ হলেও গত জানুয়ারি ২০২৫ থেকে সীমান্তবর্তী বাংলাদেশ অংশের মনু প্রতিরক্ষা বাঁধে স্থাপণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। তবে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বিএএসএফের বাঁধা এ কাজ বন্ধ রয়েছে।
আরও জানা যায়, বাংলাদেশ অংশে মনু নদীর প্রতিরক্ষা বাঁধ অস্বাভাবিকভাবে উচুঁ করা হচ্ছে আর উঁচু হলে ভারতের ত্রিপুরার ঊনকোটি জেলার কৈলাশহর বন্যা কবলিত হবে এ অপপ্রচারে গত জানুয়ারী ২০২৫ কৈলাশহর তথা আগরতলায় ভারতীয় জনতা পার্টি, কংগ্রেস ও সিপিএম বিক্ষোভ মিছিল, সড়ক অবরোধ ও প্রতিবাদ সভা করে। তারা ত্রিপুরা থেকে এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের হস্তক্ষেপ কামনা করে বিএসএফের মাধ্যমে জুড়ালোভাবে বাঁধা দিয়ে মনু নদীর প্রতিরক্ষা বাধের কাজ বন্ধ রেখেছে।
বাংলাদেশ অংশে সংস্কার কাজ না করতে প্রতিবাদে ও ভারতীয় অংশে মনু নদের বাঁধ নির্মাণের দাবীতে কংগ্রেসের নেতাকর্মীদের লং মার্চ ও প্রতিবাদ সভা অনুষ্ঠিত হয়। গত ২৫ জানুয়ারি শনিবার সকাল ১০টা থেকে বেলা ১টা পর্যন্ত এ কর্মসূচি পালন করে ভারতীয় কংগ্রেসের ঊনকোটি জেলা কমিটি। তার আগে ভারতীয় জনতা পার্টি কৈলাশহর ও আগরতলাশ প্রতিবাদ কর্মসূচি পালন করে।
ত্রিপুরা রাজ্যের বিভিন্ন গণমাধ্যম সূত্রে জানা যায়,কৈলাশহরের অংশে মনু নদীর প্রতিরক্ষা বাঁধ খুব শীঘ্রই সংস্কার কিংবা পুননির্মাণের দাবীতে এবং দেবীপুর এলাকায় ভারত বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক সীমান্তের পাশে বাংলাদেশ যে বাঁধ সংস্কার করছে তারই প্রতিবাদে ঊনকোটি জেলা কংগ্রেসের পক্ষ থেকে কৈলাসহর-কুমারঘাট রাস্তা অবরোধ করে বিক্ষোভ প্রদর্শন করছে। তার আগ থেকে ভারতীয় জনতা পার্টি, সিপিএম প্রতিবাদ কর্মসূচি পালন করেছে।
গত ২৫ জানুয়ারি কৈলাশহর কংগ্রেসের পক্ষে কৈলাসহরের বিমানবন্দর সংলগ্ন কৈলাশহর-কুমারঘাট রাস্তা অবরোধ করে শত শত দলীয় কর্মী সমর্থকরা এই রাস্তা অবরোধে সামিল হয়েছিল। রাস্তা অবরোধের নেতৃত্বে ছিলেন ত্রিপুরা রাজ্যের কংগ্রেসের বিধায়ক বিরজিত সিনহা, ঊনকোটি জেলা কংগ্রেসের সভাপতি মো. বদরুজ্জামান, প্রদেশ কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদক রুদ্রেন্দু ভট্টাচার্য, যুব কংগ্রেসের ঊনকোটি জেলা কমিটির সভাপতি দেবাংশু দাস কংগ্রেস নেতা চন্দ্রশেখর সিনহা, নরসিংহ দাস, যুব নেতা দ্বীপ সিনহা সহ আরও অন্যান্য নেতৃবৃন্দরা।
অবরোধস্থলে বক্তব্য রাখতে গিয়ে কংগ্রেস বিধায়ক বিরজিত সিনহা বলেছিলেন, কৈলাশহর মহকুমায় মনু নদীর প্রতিরক্ষা বাঁধের অবস্থা খুবই ভয়াবহ। খুব শীঘ্রই এই বাঁধ সংস্কার কিংবা পুননির্মাণ করা না হলে আসন্ন বর্ষাকালে গোটা কৈলাসহর জলের নীচে তলিয়ে যাবে। তাছাড়া দেবীপুর এলাকায় ভারত বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক সীমান্তের পাশে বাংলাদেশ সরকার যেভাবে অবৈধ বাঁধ নির্মাণ করছে তারও তীব্র সমালোচনা করেন। তিনি দাবী করেন বাংলাদেশ অংশে যে মনু প্রতিরক্ষা বাঁধ সংস্কার হচ্ছে তা অবৈধ। এজন্য তারা প্রতিবাদ করছেন।
তবে অন্যদিকে সীমান্ত এলাকার বাংলাদেশ অংশে মনু নদে উঁচু প্রতিরক্ষা বাঁধ নির্মাণ অভিযোগে গত ১৮ জানুয়ারি বিকালে সরেজমিন তদন্ত করে ভারতীয় সীমান্ত রক্ষী বিএসএফে পানি সাগরের ডিআইজি রাজিব বাটসরাজ টিলা বাজার বিএসএফ ক্যাম্পে সংবাদ সম্মেলন করে বাংলাদেশ অংশে মনু নদে উঁচু বাঁধ নির্মাণ সঠিক নয় বলে জানান।
সম্প্রতি সরেজমিন মৌলভীবাজারের কুলাউড়া উপজেলার শরীফপুর সীমান্ত এলাকা ঘুরে দেখা যায়, পাথরের ব্লক তৈরী করে জমাট করে রাখা আছে। বাংলাদেশ অংশে কোন প্রতিরক্ষা বাঁধে পাথরের ব্লক স্থাপন হচ্ছে না। গত বছরের বন্যা যে এলাকার বাঁধ ভেঙ্গেছিল সে এলাকায় পাথরের ব্লক স্থাপন কাজও বন্ধ রয়েছে। তাছাড়া শরীফপুর – কুলাউড়া সংযোগ সড়কের কাজও বিএসএফের আপত্তির কারণে বন্ধ রয়েছে।
তবে গত মঙ্গলবার (২১ এপ্রিল) প্রচারিত ত্রিপুরার কৈলাশাহরের বেরসরকারীটিভি চ্যানেল নিউজ বাংলা সূত্র জানা যায়, বিজিবির আপত্তির মুখে কৈলাশহরের শশ্মানঘাট এলাকায় ভারতীয় অংশে মনু প্রতিরক্ষা বাঁধের কাজ ৪ দিন ধরে বন্ধ রয়েছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক শরীফপুর সীমান্তের বিজিবি সূত্র এর সত্যতা নিম্চিত করে বলেন, ‘তারা যখন বাংলাদেশ অংশে মনু প্রতিরক্ষা বাঁধের কাজে বাঁধা দিয়েছে আমরাও তাদের অংশের কাজে বাঁধা দিয়েছি।’
পানি উন্নয়ন বোর্ড মৌলভীবাজারের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. খালিদ বিন অলীদ বলেন, ভারতীয়দের অভিযোগ ভিত্তিহীন ও তাদের বাঁধ অযৌক্তিক। ইতিমধ্যে দুই দেশের যৌথ নদী কমিশনে এ নিয়ে আলোচনা হয়েছে। কলকাতায় যৌথ নদী কমিশনের বৈঠক হলেও এখন সমাধান হয়নি। এ অবস্থায় মনু নদীর বাংলাদেশ অংশে বাঁধে পাথরের ব্লক স্থাপন ও কমলগঞ্জ উপজেলার ইসলামপুর ইউনিয়নের মকাবিল এলাকার ভাঙা বাঁধ মেরামত করা যাচ্ছে না বিএসএফের আপত্তির কারণে।
তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, বৃষ্টি বাদল শুরু হতে আর বেশী দেরি নেই। বর্ষায় ভারী বৃষ্টি হলেও উজানের ভারতীয় পাহাড়ি ঢলের পানিতে মনু নদী ভরে উপচে পানি প্রবেশ করে বাংলাদেশী সীমান্ত গ্রামগুলো প্লাবিত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।