ইবির বটতলায় বৈশাখী মেলা; ঐতিহ্য আর তারুণ্যের মিলনক্ষেত্র

মিজানুর রহমান, ইবি প্রতিনিধি:
বাংলা নববর্ষ ১৪৩২-এর আগমনকে বরণ করে নিতে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় (ইবি) সেজেছে এক নতুন রূপে। বৈশাখের আনন্দ আর উদ্দীপনায় মুখরিত ক্যাম্পাস প্রাঙ্গণ, যেখানে বটতলাকে কেন্দ্র করে স্বপ্নবিতান ইবি পরিসরের উদ্যোগে বসেছে দুই দিনব্যাপী বৈশাখী মেলা – “বৈশাখীয়ানা উৎসব- ১৪৩২”। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণে এই মেলা পরিণত হয়েছে এক মিলনমেলায়, যেখানে ঐতিহ্য আর তারুণ্যের এক চমৎকার মেলবন্ধন দেখা যাচ্ছে।
মেলার প্রথম দিন থেকেই ইবিয়ানদের উচ্ছ্বাস ছিল চোখে পড়ার মতো। বাংলার চিরায়ত গান আর নৃত্যের মনোমুগ্ধকর পরিবেশ সৃষ্টি হয়, যা আগত দর্শকদের মন জয় করে নেয়। এই আনন্দমুখর সূচনা যেন মেলার বাকি দিনগুলোর আগমনী বার্তা দেয়।
মেলার প্রধান আকর্ষণগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো নাগরদোলা আর চড়কি। ছোট-বড় সকলের মনেই এই দুটি জিনিস নস্টালজিয়া জাগিয়ে তোলে। আকাশে পাক খাওয়া নাগরদোলা আর দ্রুত ঘূর্ণায়মান চড়কিতে ভেসে বেড়ানো মানুষের আনন্দধ্বনি পুরো মেলা প্রাঙ্গণকে মাতিয়ে রেখেছে।
এক কোণে দেখা যায় হাওয়ার বন্দুকের স্টল। লম্বা একটি বোর্ডে থরে থরে সাজানো রঙিন বেলুনগুলো যেন রঙের এক মনোরম দেয়াল তৈরি করেছে। হাতে বন্দুক, চোখে স্থির লক্ষ্য, আর ট্রিগারে সামান্য চাপ – ব্যস! বেলুন ফাটার শব্দে চারদিকে হাসির রোল ওঠে, এক ছোটখাটো বিজয় যেন সকলের মুখে ছড়িয়ে দেয় অনাবিল আনন্দ। এই খেলায় মত্ত সকলে যেন ফিরে যায় তাদের শৈশবের সেই সোনালী দিনগুলোতে। এমনকি অনেক দম্পতিকেও দেখা যায় একে অপরের সাথে মজার প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে, যা শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের “হাওয়াবন্দুক” গল্পের সেই প্রেমিক-প্রেমিকার তীব্র উত্তেজনাপূর্ণ বেলুন ফোটানোর দৃশ্যকে মনে করিয়ে দেয়। তাদের এই প্রতিযোগিতা যেন সম্পর্কের ছোট ছোট মিষ্টি যুদ্ধেরই প্রতিচ্ছবি।
জিভের স্বাদ বদলাতে মেলায় রয়েছে বাহারি রকমের চায়ের সম্ভার। মালটা চা, ব্রেকাপ চা (নাম শুনেই কৌতূহল জাগে!), তেঁতুল চা, মরিচ চা থেকে শুরু করে ক্ল্যাসিক কফি – সব কিছুই পাওয়া যাচ্ছে এখানে। ক্লান্ত পথিক কিংবা চায়ের রসিকরা ভিড় করছেন এই স্টলগুলোতে, প্রতিটি চুমুকে যেন নতুন এক অনুভূতি।
আচারের স্বাদ নিতে যারা ভালোবাসেন, তাদের জন্য রয়েছে লোভনীয় সব আয়োজন। খেজুরের মিষ্টি আচার, মরিচের ঝাল আচার, আমের টক-মিষ্টি আচার, এমনকি চেরি ফলের আচারও পাওয়া যাচ্ছে। নানা স্বাদের এই আচারগুলো যেন বাঙালির রসনা তৃপ্তির এক অসাধারণ মাধ্যম।
“রূপরত্ন” নামের একটি স্টলে কিছু ভাই বাহারি রঙের ও সুন্দর সব চুড়ি বিক্রি করছেন। রমণীরা ভিড় করছেন সেখানে, নিজেদের পছন্দের রঙের আর ডিজাইনের চুড়ি বেছে নিতে। হাতের রঙিন চুড়ি যেন বৈশাখের সাজে যোগ করেছে এক নতুন মাত্রা।
“বৈশাখের চিনি রং” নামের স্টলটিতে দেখা যাচ্ছে বিভিন্ন রকমের মুখরোচক খাবার আর ঠান্ডা শরবতের সমাহার। বৈশাখের গরমে একটু শান্তি পেতে অনেকেই ঢুঁ মারছেন এখানে। মিষ্টি আর ঠান্ডা পানীয় যেন দেহ ও মনকে সতেজ করে তোলে।
ইবি ক্যাম্পাসের পরিচিত মুখ “মাচাং” রেস্টুরেন্টও মেলায় তাদের উপস্থিতি জানান দিচ্ছে। হয়তো তাদের বিশেষ কোনো খাবারের আয়োজন রয়েছে, যা মেলায় আগতদের আকৃষ্ট করছে।
কসমেটিকসের স্টলগুলোতে দেখা যাচ্ছে বাহারি ডিজাইনের বিভিন্ন রকমের প্রসাধনী। তরুণীরা ভিড় করছেন নিজেদের সাজসজ্জার জন্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনতে। বৈশাখের সাজ যেন এই প্রসাধনীর ছোঁয়ায় আরও প্রাণবন্ত হয়ে উঠছে।
“আরশীনগর”-এ কেন এত ভিড়, তা হয়তো ভেতরে না গেলে বোঝা যাবে না। তবে ক্রেতাদের আনাগোনা দেখে মনে হচ্ছে, সেখানে নিশ্চয়ই কিছু বিশেষ আকর্ষণ রয়েছে।
“সুতির পরশ” নামের স্টলটি যেন দেশীয় ঐতিহ্যের প্রতিচ্ছবি। এখানে বিভিন্ন ধরনের লুঙ্গি, গেঞ্জি, শার্ট বিক্রি হচ্ছে, বিশেষ করে যদি কোনো অফার থাকে তবে তো কথাই নেই! এছাড়াও এখানে পাওয়া যাচ্ছে জি আই পণ্য তিলের খাজা, যা স্বাদে ও ঐতিহ্যে অনন্য।
“বনলতা”, হ্যাঁ ঠিকই ধরেছেন, এটি নাটোরের সেই বিখ্যাত বনলতা সেন না, বরং এটি একটি কসমেটিকসের দোকান। তবে নামের সাথে সৌন্দর্যের একটি যোগসূত্র তো রয়েছেই। এখানে বিভিন্ন ধরনের প্রসাধনীর পসরা সাজানো, যা আকৃষ্ট করছে ক্যাম্পাসের সুন্দরীদের।
“নির্বান”-এ পাওয়া যাচ্ছে মেয়েদের পছন্দের চুড়ি আর ফিতা। এই ছোট ছোট জিনিসগুলোও বৈশাখের সাজে একটি বিশেষ আকর্ষণ যোগ করে।
“রসনা বিলাস”-এ রয়েছে বিভিন্ন স্বাদের বাহারি কেকের সমাহার। মিষ্টিপ্রিয়দের জন্য এটি একটি দারুণ জায়গা, যেখানে নানা ফ্লেভারের কেক চেখে দেখার সুযোগ রয়েছে।
“মধু মসলা”-তে পাওয়া যাচ্ছে বিভিন্ন ধরনের শরবত ও তরল খাবার, যা গরমে শরীরকে ঠান্ডা রাখতে সাহায্য করে।
“অস্থির খানাপিনা” নামের স্টলটি ভাজাপোড়া জাতীয় খাবারের জন্য বিখ্যাত। নানা ধরনের মুখরোচক ভাজা খাবার দেখলে জিভে জল আসা স্বাভাবিক।
শিশুদের আনন্দ দেওয়ার জন্য রয়েছে “খেলনা ঘর”। এখানে বিভিন্ন ধরনের খেলনার আইটেম পাওয়া যাচ্ছে, যা ছোটদের মন জয় করে নেয়।
ভাগ্য পরীক্ষা করার সুযোগও রয়েছে এই মেলায় – লটারির ব্যবস্থা করা হয়েছে। অনেকেই ভিড় করছেন নিজেদের ভাগ্য যাচাই করতে, হয়তো একটি অপ্রত্যাশিত পুরস্কার তাদের জন্য অপেক্ষা করছে।
শুধু খাবার আর খেলার সামগ্রীই নয়, এই মেলায় রয়েছে বিভিন্ন ধরনের বইয়ের সমাহার। জ্ঞানপিপাসু মানুষের জন্য এটি একটি দারুণ সুযোগ, যেখানে তারা তাদের পছন্দের লেখকের বা পছন্দের বিষয়ের বই খুঁজে নিতে পারবেন।
সবশেষে, আধুনিক প্রজন্মের পছন্দের কথা মাথায় রেখে মেলায় পিজ্জা, নাগা মিটবক্স ও বারবিকিউ মিটবক্সের স্টলও দেখা যাচ্ছে। ঐতিহ্যবাহী মেলার সাথে এই আধুনিক খাবারের সংযোজন যেন সব ধরনের দর্শকের মন জয় করে নিয়েছে।
মোটকথা, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের “বৈশাখীয়ানা” উৎসব ১৪৩২ শুধু একটি মেলা নয়, এটি ইবিয়ানদের মিলনমেলা, যেখানে আনন্দ, উল্লাস আর ভালোবাসার এক নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়েছে। এই মেলা ক্যাম্পাসের শিক্ষার্থীদের উদ্যোক্তা হিসেবে নিজেদের প্রতিভা বিকাশের একটি সুযোগ করে দিয়েছে, পাশাপাশি সকলের মাঝে একাত্মতা আর ঐতিহ্যের প্রতি সম্মান জানানোর একটি সুন্দর প্ল্যাটফর্ম তৈরি করেছে। বৈশাখের এই আনন্দধারা যেন বছরজুড়ে ইবি ক্যাম্পাসে প্রবাহিত হয়, সেই কামনাই সকলের।